জীবনের নীল নকশা অথবা ডিএনএ উপাখ্যান

মারা গেলেন নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর।

জেমস ওয়াটসন ছিলেন ডিএনএর রাসায়নিক গঠনের সহ-আবিষ্কারক। ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে যৌথভাবে এ আবিষ্কার করেন তিনি। তাঁদের এ আবিষ্কারকে বলা হয় ২০ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এর স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬২ সালে মরিস উইলকিন্স ও ফ্রান্সিস ক্রিকের সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান ওয়াটসন।

ডিএনএ-কে বলা হয় জীবনের নীল নকশা। ওয়াটসনও একে ‘মাস্টার ব্লুপ্রিন্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।কিন্তু কেন?

‘সেই ১৯৫৩ সাল থেকে…’—দেশীয় রং কোম্পানি রক্সি পেইন্টের এমন জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনী ভাষা যদি না শুনে থাকেন, তাহলে আপনার জন্য সমবেদনা। ওই সালটা জীববিজ্ঞানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বছর—একটা মাইলফলক। না, সেটা রক্সি পেইন্টের যাত্রা শুরু বলে নয়। বরং ওই সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল ডিএনএ-এর রাসায়নিক গঠন। এর সহ-আবিষ্কারক জেমস ওয়াটসন তারপর বলেছিলেন, ‘ডিএনএ হলো সবকিছুর জন্য মাস্টার ব্লুপ্রিন্ট।’

ভাবছেন, এ কথার মানে কী? এর মানে বুঝতে সরল একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আপনি বাড়ি বানাতে চান। বলা বাহুল্য, সেজন্য প্রথমেই দরকার হবে একখণ্ড জমি। ‘শূন্যের মাঝারে’ আর যাই হোক ঘরবাড়ি বানানো যায় না। তারপর দরকার জমির আকার অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা। মানে একটা নীল রকশা—এটাই বাড়ির মাস্টার ব্লু প্রিন্ট। এতে আঁকা থাকবে বাড়িটার কোথায় দরজা-জানালা, কোথায় বারান্দা বা বাথরুম, কিচেন কিংবা কোনটার দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ কতটুকু হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। জমির মাপ ও আপনার চাহিদা অনুযায়ী সব কিছুই নীল নকশায় নির্দিষ্টভাবে আঁকা থাকে। বিল্ডিং সংক্রান্ত সব তথ্যই থাকে এতে।

শুধু বাড়ি নয়, যেকোনো জীবদেহ গড়ে ওঠার জন্যেও লাগে নীল নকশা। হোক সেটা ব্যাকটেরিয়ার মতো অতিক্ষুদ্র জীব, গোলাপ ফুলগাছ কিংবা পাখি, মানুষ, নীল তিমি—সব জীবের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্যি। জীবের এ নীল নকশাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ডিএনএ বা ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড। একটা জীব দেখতে কেমন হবে—সেটা মানুষ হবে নাকি গাধা—তার সমস্ত তথ্য জমা থাকে ডিএনএতে।

বাড়ির নীল নকশা যেমন গুরুত্বপূর্ণ জীবনের নীলনকশাও তেমনি। তাই একে যেখানে সেখানে নয়, রাখতে হয় নিরাপদ জায়গায়। কোনো ভল্ট বা সিন্দুকের ভেতর। জীবদেহেও ডিএনএকে থাকে সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গায়। কোষের একেবারে কেন্দ্রে—নিউক্লিয়াসের মাঝখানে। যাতে প্রতিটি কোষ তার প্রয়োজনীয় সব তথ্য খুব সহজে হাতের কাছে পেতে পারে। কাজেই আপনার শরীরের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষের প্রায় প্রতিটির ভেতরেই আছে এই নীলনকশার একটি নিখুঁত কপি।

আরও পড়ুন
জীবের এ নীল নকশাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ডিএনএ বা ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড। একটা জীব দেখতে কেমন হবে—সেটা মানুষ হবে নাকি গাধা—তার সমস্ত তথ্য জমা থাকে ডিএনএতে।

মানুষের একটি কোষে থাকা সম্পূর্ণ ডিএনএ যদি লম্বা করে টানা হয়, তাহলে তার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় দুই মিটার বা প্রায় সাড়ে ৬ ফুট। মানে প্রায় একজন প্রমাণ সাইজের মানুষের সমান। অথচ এই বিশাল দৈর্ঘ্যের সুতোকে এমনভাবে গুটিয়ে রাখা হয় যে সেটি ঢুকে যায় একটি কোষের অতিক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসে। ব্যাপারটা অনেকটা একটি ফুটবল মাঠের সমান লম্বা সুতো একটি ফুটবলের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো। এই অবিশ্বাস্য প্যাকিংয়ের জন্য ডিএনএ নানারকম প্রোটিনের চারপাশে পেঁচিয়ে গুটিয়ে থাকে, অনেকটা সুতার কাছি বোনার মতো। কোনো উপায়ে যদি একজন মানুষের মোট দেহকোষের ডিএনএ লম্বালম্বি বরাবর রাখা হয়, তাহলে কী হবে?

এভাবে যে দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে সেটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। দৈর্ঘ্যটা এতই বড় যে তা দিয়ে পৃথিবী থেকে সূর্য পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বার পাক দেওয়া যাবে। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা! কিন্তু এই নীল নকশাটি দেখতে কেমন?

সহজভাবে বললে, এটি দেখতে একটি প্যাঁচানো সিঁড়ি বা মইয়ের মতো। ঠিক যেন রহস্য উপন্যাসের মতো ঘোরানো-প্যাঁচানো সিঁড়িটা। বিজ্ঞানীরা এর পোশাকি নাম দিয়েছেন ডাবল হেলিক্স (Double Helix)। সিঁড়িটার গঠনও বিশেষ ধরনের। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে এর গঠন আবিষ্কারের জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন কজন বিজ্ঞানী। শেষমেশ ১৯৫৩ সালে নাটকীয় ভাবে এতে সফল হন দুজন—জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক। সে কথা শুরুতেই বলেছি। এই আবিষ্কার ছিল বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর একটি। সে কারণেই ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কার পান এই দুই বিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন
মানুষের একটি কোষে থাকা সম্পূর্ণ ডিএনএ যদি লম্বা করে টানা হয়, তাহলে তার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় দুই মিটার বা প্রায় সাড়ে ৬ ফুট। মানে প্রায় একজন প্রমাণ সাইজের মানুষের সমান।

২.

বিজ্ঞানীদের ধারাবাহিক গবেষণার কারণে এখন আমরা জানি, ডিএনএতে থাকে মাত্র তিনটি উপাদান। সেগুলো হলো সুগার বা চিনি, ফসফেট যৌগ এবং নাইট্রোজেন ক্ষার। আরেকটু খুলে বলি। ডিএনএ অণুর চিনি আপনার চায়ের সঙ্গে গুলিয়ে খাওয়া যাবে না। এ যেনতেন চিনি নয়, একে বলে ডিঅক্সিরাইবোজ সুগার (Deoxyribose Sugar)। এটি পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট একটি শর্করা অণু। ডিএনএ-এর নামের ‘ডিঅক্সি’ অংশটি এসেছে এই শর্করা থেকে। ওদিকে ফসফেট যৌগ আসলে একটি ফসফরাস পরমাণু ও চারটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত একটি রাসায়নিক গ্রুপ। আর নাইট্রোজেনাস বেস বা ক্ষার হলো নাইট্রোজেনযুক্ত রিং-আকৃতির এক ধরনের জৈব অণু। ডিএনএ-তে চার প্রকারের নাইট্রোজেনাস বেস থাকে। সেগুলো হলো অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং থাইমিন। সংক্ষেপে যথাক্রমে A, G, C, T। নামগুলো একটু মনে রাখার চেষ্টা করবেন।

এখন জানার বিষয় হলো এই অণুগুলো ডিএনএতে কীভাবে সাজানো থাকে? ১৯৫৩ সালের আগপর্যন্ত সেটা ছিল বেশ বড় এক রহস্য। সে রহস্য উদঘাটন করেন ফ্রান্সিস আর ক্রিক–সে কথা তো কিছুক্ষণ আগেই জেনেছেন। এই তিন মূল উপাদান মিলে ডিএনএ-এর গাঠনিক একক তৈরি করে। একে বলে নিউক্লিওটাইড (Nucleotide)। ​প্রতিটি নিউক্লিওটাইড একটি ফসফেট গ্রুপ, একটি ডিঅক্সিরাইবোজ সুগার এবং একটি নাইট্রোজেনাস বেস (A, T, C, বা G-এর যেকোনো একটি) দিয়ে গঠিত।

আসলে A, G, C, T—এ চারটি অক্ষরই হলো জীবনের বর্ণমালা। বিস্ময়ের ব্যাপার, এই বর্ণমালা সব উদ্ভিদ বা প্রাণীতেই একই। মাত্র এই চারটি অক্ষর দিয়েই লেখা হয়েছে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের মহাকাব্য! ঠিক যেমন মাত্র কয়েকটি স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে তৈরি হয় হাজার হাজার শব্দ, লাখ লাখ বই, তেমনি এই চারটি অক্ষর বিভিন্ন বিন্যাসে সেজে তৈরি করে জীবনের সমস্ত নির্দেশনা। ব্যাকটেরিয়া থেকে নীল তিমি পর্যন্ত সবাই একই রাসায়নিক বর্ণমালা ব্যবহার করে। জীবজগতে এর চেয়ে সুন্দর একতার উদাহরণ আর কী হতে পারে!

আরও পড়ুন
প্রতিটি নিউক্লিওটাইড একটি ফসফেট গ্রুপ, একটি ডিঅক্সিরাইবোজ সুগার এবং একটি নাইট্রোজেনাস বেস (A, T, C, বা G-এর যেকোনো একটি) দিয়ে গঠিত।

ডিএনএ অণু হলো এরকম লক্ষ লক্ষ নিউক্লিওটাইডের একটি দীর্ঘ শেকল। এ শেকলই ডাবল হেলিক্স বা প্যাঁচানো মইয়ের মতো দেখতে। ভাবছেন, সেটা আবার কেমন?

এই মুহূর্তে একটা মইয়ের কথা ভাবুন। একটা মইয়ে কী থাকে? মইয়ের দুপাশে থাকে লম্বা দড়ি আর একটু দূরে দূরে থাকে ধাপ, তাই তো। মনে করুন, আপনার সামনে একটি দড়ির মই আছে। সেটা সোজা মই নয়, একটু প্যাঁচানো। এর দুই পাশের দড়ি পরস্পরকে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। ডিএনএ মইয়ের দড়ি তৈরি হয় ফসফেট গ্রুপ ও ডিঅক্সিরাইবোজ সুগার অণুর পর্যায়ক্রমিক বন্ধন দিয়ে। মইয়ের ধাপগুলো যেমন দুই পাশের দড়িকে যুক্ত করে, ঠিক তেমনি ডিএনএ-র মইয়ের ধাপ তৈরি হয় নাইট্রোজেনাস বেসগুলোর জোড় বাঁধার মাধ্যমে। অর্থাৎ অ্যাডেনিন, থাইমিন, গুয়ানিন ও সাইটোসিন।

এই চারটি ক্ষারের জোড় বাঁধারও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন আছে। এই নিয়মে ​অ্যাডেনিন (A) সব সময় থাইমিন (T)-এর সঙ্গে জোড় বাঁধে। আর ​গুয়ানিন (G) সব সময় জোড় বাঁধে সাইটোসিন (C)-এর সঙ্গে। এর ব্যতিক্রম হয় না। যেন চাররকম পাজলের টুকরো, যেখানে A আর T একে অপরের পরিপূরক এবং C আর G একে অপরের পরিপূরক। এই নির্দিষ্ট জোড় বাঁধার কারণেই ডিএনএ তার আকৃতি ধরে রাখতে পারে এবং নির্ভুলভাবে নিজের অনুলিপি তৈরি করতে পারে।

এ বেলায় কেউ কেউ হয়তো একটা কথা চিন্তা করে  নিজের ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে ফেলতে পারেন। সেটা হলো, মাত্র চারটি অক্ষর দিয়ে কীভাবে লেখা সম্ভব এত এত জটিল তথ্য?

আরও পড়ুন
ডিএনএ-তে থাকা তথ্যের বিশেষ অংশগুলোকে বলা হয় জিন। একেকটি জিন হলো একেকটি নির্দেশনা বা রেসিপি।

উত্তরটা সহজ। সেটা অনেকটা কম্পিউটারের মতো। কম্পিউটার কাজ করে বাইনারি পদ্ধতিতে। মানে মাত্র দুটি সংখ্যা—শূন্য এবং এক—ব্যবহার করে সবকিছু গণনা করতে পারে। তেমনি এই চারটি রাসায়নিক অক্ষরের বিভিন্ন সাজানোর মাধ্যমে ডিএনএ লিখে রাখে— কীভাবে একটি কোষ প্রোটিন তৈরি করবে, কীভাবে কাজ করবে, কখন বিভাজিত হবে—সবকিছু। কাজেই মাত্র চারটি অক্ষরের এই সরল ভাষা দিয়ে লেখা জীবনের এই জটিল ও সুন্দর নীলনকশা প্রকৃতির সবচেয়ে বড় বিস্ময়গুলোর মধ্যে একটি।

৩.

ডিএনএ-এর এই বর্ণমালা দিয়ে লেখা নির্দেশনাগুলোকে বলা হয় জিন (Gene)। সহজ করে বললে, ডিএনএ-তে থাকা তথ্যের বিশেষ অংশগুলোকে বলা হয় জিন। একেকটি জিন হলো একেকটি নির্দেশনা বা রেসিপি। ডিএনএকে যদি বিশাল এক বইয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে জিন হলো সেই বইয়ের নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বা অধ্যায়—যেখানে একটি বিশেষ নির্দেশ লেখা আছে। এরাই কোষকে বলে দেয়—কীভাবে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি করতে হবে। কিন্তু প্রোটিন কেন? দেহে প্রোটিন তৈরির দরকারটা কী?

প্রোটিনকে  বলা হয় জীবনের গাঠনিক একক বা জীবনের ইট-পাথর। কারণ এটি জীবন্ত দেহের গঠন, বৃদ্ধি, রক্ষণাবেক্ষণ ও এনজাইম সংক্রান্ত কাজকর্মে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। প্রোটিন আমাদের শরীরের কর্মী মতো। তারা প্রায় সব কাজই করে। চুল তৈরি করা, খাবার হজম করা, রোগজীবাণু মারা—সবকিছুতেই প্রোটিনের ভূমিকা আছে।

এক কথায় বললে, প্রোটিনই হলো জীবদেহের আসল খেলোয়াড়। আমাদের গাঠনিক উপাদান। প্রোটিন দিয়েই দেহের বিভিন্ন অঙ্গ—যেমন হাত-পা, নাক-মুখ, ত্বক, নখ, চুল ইত্যাদি তৈরি হয়। আবার প্রোটিনের কারণেই আমরা খাবার হজম করতে পারি। কারণ আমরা যে খাবার খায় তা পাকস্থলীতে শোষণ উপযোগী করতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় ভেঙে ফেলতে হয়। আর সে কাজটি করে এনজাইম নামের এক রাসায়নিক উপাদান। এনজাইমও এক ধরনের প্রোটিন। আবার আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোগায় ওই প্রোটিন। অর্থাৎ, নীলনকশার নির্দেশগুলো বাস্তবে রূপ দেয় প্রোটিন অণু।

আরও পড়ুন
প্রোটিনকে  বলা হয় জীবনের গাঠনিক একক বা জীবনের ইট-পাথর। কারণ এটি জীবন্ত দেহের গঠন, বৃদ্ধি, রক্ষণাবেক্ষণ ও এনজাইম সংক্রান্ত কাজকর্মে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।

​কিন্তু এই নীলনকশা তো কোষের সিন্দুকে বা নিউক্লিয়াসে সুরক্ষিত। কিন্তু কোষের প্রোটিন তৈরির কারখানা থাকে সিন্দুকের বাইরে। অর্থাৎ রাইবোজোম নামের কোষীয় অঙ্গাণুতে। তাহলে প্রোটিন তৈরি হয় কীভাবে?

জিন থেকে প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ চমকপ্রদ। ডিএনএকে আমরা কিছুক্ষণ আগেই একটা বইয়ের সঙ্গে তুলনা করেছি। ধরা যাক, এর প্রতিটি পাতায় বিভিন্ন রেসিপি লেখা আছে—প্রোটিন তৈরির রেসিপি। প্রতিটি জিন হলো সেই বইয়ের একেকটি নির্দিষ্ট রেসিপি। যেমন, একটা রেসিপি হয়তো বলছে কীভাবে ‘চোখের মণির রঙ’ বানাতে হবে। আরেকটা রেসিপি বলছে কীভাবে রক্তের অক্সিজেন বহনকারী হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে হবে। মাথার চুলগুলো কোঁকড়া হবে নাকি সোজা, নাকটা বোচা হবে নাকি তীক্ষ্ণ—তার রেসিপিও লেখা থাকে এখানে।

এখানে ডিএনএ-এর এক বিশ্বস্ত দূতের মতো কাজ করে আরেকটি রাসায়নিক যৌগ। এর নাম আরএনএ (RNA) বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। দেহে যখন কোনো নির্দিষ্ট প্রোটিন দরকার হয়, তখন কোষের ভেতরের এক বিশেষ ব্যবস্থা সেই বিশাল রান্নার বই (ডিএনএ) থেকে নির্দিষ্ট রেসিপিটা (জিন) একটা ছোট কাগজে টুকে নেয়। এই টুকে নেওয়া কপি বা ফটোকপিই হলো আরএনএ। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সক্রিপশন। এটা অনেকটা একটি বইয়ের পাতা থেকে নোট করার মতো। তারপর এই আরএনএ-র নোট বয়ে নিয়ে যায় কোষের প্রোটিন তৈরির কারখানায়। মানে রাইবোজোমে।

কারখানার কর্মীরা (রাইবোজোম) সেই ফটোকপি দেখে দেখে হুবহু রেসিপি অনুযায়ী প্রোটিনটি বানিয়ে ফেলে। সেখানে আরএনএ-র তথ্য অনুযায়ী সঠিক ক্রমে অ্যামিনো অ্যাসিড জুড়ে জুড়ে তৈরি হয় প্রোটিন। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সলেশন। সহজ করে বললে, ডিএনএ হলো মূল রেসিপি বই, যা লাইব্রেরিতে সযত্নে রাখা থাকে। আর আরএনএ হলো সেই রেসিপির ফটোকপি। অন্যদিকে প্রোটিন হলো রান্না করা খাবার।

আরও পড়ুন
দেহে যখন কোনো নির্দিষ্ট প্রোটিন দরকার হয়, তখন কোষের ভেতরের এক বিশেষ ব্যবস্থা সেই বিশাল রান্নার বই (ডিএনএ) থেকে নির্দিষ্ট রেসিপিটা (জিন) একটা ছোট কাগজে টুকে নেয়। এই টুকে নেওয়া কপি বা ফটোকপিই হলো আরএনএ।

মাঝে মাঝে এই কপি করার সময় সামান্য ভুল হয়ে যেতে পারে। একে বলে মিউটেশন  বা পরিব্যক্তি। এটা অনেকটা টাইপরাইটারে টাইপ করার সময় একটা অক্ষর ভুল হওয়ার মতো। এতে হয়তো একটি অক্ষর বদলে যায়, যোগ হয়, কিংবা বাদ পড়ে। বেশিরভাগ সময় এই টাইপিং মিস্টেক কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু কখনও কখনও এই সামান্য ভুলের কারণে দেহে বড় ধরনের ক্ষতিও হতে পারে। রেসিপিটা বদলে গেলে অনেক সময় প্রোটিন ঠিকমতো তৈরি হয় না এবং নানা ধরনের জিনগত রোগ দেখা দিতে পারে। যেমন সিকেল সেল অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া বা কিছু ক্যান্সার হয় ডিএনএ-র নির্দিষ্ট মিউটেশনের কারণে। আবার, খুব বিরল ক্ষেত্রে, এই ভুলগুলো কোনো নতুন সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যেরও জন্ম দিতে পারে। সেটা হয়তো একটা জীবকে তার পরিবেশে আরও ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। এভাবেই ডিএনএ-এর সামান্য পরিবর্তন লাখ লাখ বছর ধরে পৃথিবীতে এই বিশাল জীববৈচিত্র্য তৈরি করেছে।

৪.

মানুষের ডিএনএ-তে কতগুলো জিন আছে? বিজ্ঞানীরা একসময় ভেবেছিলেন, মানুষের মতো জটিল প্রাণীতে হয়তো লক্ষাধিক জিন থাকবে। কিন্তু ২০০৩ সালে সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকোয়েন্সিং শেষে বিজ্ঞানীরা কিছুটা অবাকই হয়েছেন। কারণ দেখা গেল, মানুষের জিনের সংখ্যা মাত্র প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার। সংখ্যাটা খুব বেশি না। একটি সাধারণ ধানগাছেরও প্রায় একই সংখ্যক জিন আছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, ধানগাছের তুলনায় মানুষ এত জটিল কেন?

উত্তরটা লুকিয়ে আছে জিনের ব্যবহারে। একই জিন বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কোষে বিভিন্নভাবে কাজ করতে পারে। অনেকটা একই বাদ্যযন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন সুর তৈরি করার মতো।

আরও পড়ুন
২০০৩ সালে সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকোয়েন্সিং শেষে বিজ্ঞানীরা কিছুটা অবাকই হয়েছেন। কারণ দেখা গেল, মানুষের জিনের সংখ্যা মাত্র প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার। সংখ্যাটা খুব বেশি না।

যাই হোক, জীবনের জন্য এই নীলনকশা শুধু তথ্য জমিয়েই রাখে না, একে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়াও এর গুরুত্বপূর্ণ কাজ।  একটি কোষ যখন বিভাজিত হয়ে দুটি নতুন কোষে পরিণত হয়, তখন তাকে এই নীলনকশাটিও হুবহু কপি করে নতুন কোষকে দিতে হয়। এই প্রক্রিয়াটিও বিস্ময়কর। কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ মইটি ঠিক একটা জিপার খোলার মতো মাঝ বরাবর দুই ভাগে আলাদা হয়ে যায়। তখন কোষের ভেতরে ভাসমান নতুন A, T, C, G অক্ষরগুলো এসে পুরনো ধাপগুলোর সঙ্গে তাদের নিয়ম মেনে জোড় বাঁধতে থাকে। ফলে একটি প্যাঁচানো মই থেকে অবিকল দুটি নতুন প্যাঁচানো মই তৈরি হয়ে যায়। এভাবেই বাবা-মায়ের ডিএনএ-এর অর্ধেক আর অর্ধেক মিলে সন্তানের ডিএনএ তৈরি হয়। আর তাদের বৈশিষ্ট্যগুলোও বংশপরম্পরায় সন্তানদের মধ্যে বয়ে চলে।

যেমন মানুষের ডিএনএ সাজানো থাকে ৪৬টি বা ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমে। কোষের নিউক্লিয়াসে ডিএনএগুলো সুন্দরভাবে ভাঁজ করে, পাকিয়ে, সংরক্ষণ করার জন্য এক বিশেষ প্যাকেটে রাখা হয়। সেই প্যাকেটের নামই ক্রোমোজম। মানবদেহের ক্রোমোজোমের প্রতিটি জোড়ার একটি আসে মায়ের কাছ থেকে, আরেকটি বাবার কাছ থেকে। এজন্যই সন্তান মা-বাবা উভয়ের বৈশিষ্ট্য পায়। কখনো কখনো একই জিনের দুটি সংস্করণ থাকে—একটি হয়তো বলছে চোখ বাদামি হবে, আরেকটি বলছে নীল হবে। এক্ষেত্রে যেটি বেশি শক্তিশালী, সেটিই প্রকাশ পায়। যে বৈশিষ্ট্যটি প্রকাশ পায় তাকে বলে প্রকট বৈশিষ্ট্য এবং যেটি অপ্রকাশিত থাকে, তাকে বলে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য। যেমন বাদামী ও নীল চোখের মধ্যে সাধারণত বাদামীটিই প্রকট বৈশিষ্ট্য হয়।

ডিএনএ সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে আমরা জেনেছি, এই ছোট্ট রাসায়নিক পদার্থটি আমাদের শুধু পূর্বপুরুষদের সঙ্গেই নয় পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। আমরা সবাই একই প্রাচীন বংশধারার অংশ, একই মহাজাগতিক যাত্রার সহযাত্রী।

আরও পড়ুন
মানুষের ডিএনএ সাজানো থাকে ৪৬টি বা ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমে। কোষের নিউক্লিয়াসে ডিএনএগুলো সুন্দরভাবে ভাঁজ করে, পাকিয়ে, সংরক্ষণ করার জন্য এক বিশেষ প্যাকেটে রাখা হয়। সেই প্যাকেটের নামই ক্রোমোজম।

৫.

ডিএনএ নিয়ে এসব আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে আমূলে বদলে দিয়েছে। আজকাল পুলিশ অপরাধ সমাধানে ডিএনএ ব্যবহার করে। অপরাধস্থল থেকে পাওয়া একটুখানি চুল, রক্ত বা লালা থেকে ডিএনএ পরীক্ষা করে অপরাধীকে শনাক্ত করা যায়। কারণ প্রতিটি মানুষের ডিএনএ অনন্য (একমাত্র যমজ ছাড়া)। এটা অনেকটা আঙুলের ছাপের মতো, কিন্তু তার চেয়েও নির্ভুল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিএনএ-র ব্যবহার আরও বিপ্লবী। বংশগত রোগ নির্ণয়, ব্যক্তিগত ঔষধ তৈরি, এমনকি জিন থেরাপির মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ জিন প্রতিস্থাপন করার চেষ্টাও চলছে এর মাধ্যমে।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন CRISPR নামে একটি বিস্ময়কর প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে ডিএনএ সম্পাদনা করা যায়। ব্যাপারটা অনেকটা ওয়ার্ড প্রসেসরে টাইপ করা লেখা এডিট করার মতো। যেন আপনি একটি বইয়ের একটি শব্দ কেটে নতুন শব্দ বসিয়ে দিচ্ছেন। তবে কথাটা শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে বাস্তবে ব্যাপারটা খুবই সুক্ষ্ণ ও জটিল। এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা অসীম—বংশগত রোগ নিরাময় থেকে শুরু করে খরা বা লবণ-সহিষ্ণু ফসল তৈরি পর্যন্ত। তৈরি করা যায় উচ্চ ফলনশীল কোনো ফসল। আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এ ধরনের কাজ করেছেন। যেমন জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী, হাসিনা খান, জেবা ইসলাম সেরাজ, তোফাজ্জল ইসলামসহ আরও অনেকে।

চলতি শতকের শুরুর দিকে বহুল আলোচিত ছিল মানব জিনোম প্রজেক্ট। এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ মানব ডিএনএ পড়ার বিশাল চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার খরচে প্রায় ১৩ বছরের সাধনায় এ প্রজেক্ট শেষ হয়েছিল ২০০৩ সালে। তবে এখন একজন মানুষের সম্পূর্ণ জিনোম পড়া যায় কয়েক ঘণ্টায়। খরচও চলে এসেছে হাতের নাগালে।

আরও পড়ুন
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন CRISPR নামে একটি বিস্ময়কর প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে ডিএনএ সম্পাদনা করা যায়।

এই তো গত দশকে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী। একইভাবে ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন বিজ্ঞানী হাসিনা খানের নেতৃত্বে আমাদের দেশের একদল গবেষক। আবার করোনা মহামারীর সময় করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেশে-বিদেশে বেশ একটা হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী।

প্রযুক্তির এই দ্রুত অগ্রগতি আমাদের সামনে একের পর এক খুলে দিচ্ছে অসীম সম্ভাবনার দরজা। হয়তো আগামী দশকে আমরা দেখবো প্রতিটি নবজাতকের জন্মের সময়ই তার জিনোম সিকোয়েন্স করা হচ্ছে, যাতে আগে থেকেই জানা যায় তার কোন রোগের ঝুঁকি আছে। কারণ আমরা এখন জানি কীভাবে জীবনের নীলনকশা পড়তে হয়, কিছুটা সম্পাদনাও করতে পারি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আমরা সবকিছু করতে পারি বা করা উচিত।

ডিএনএ-র জগৎ এখন পর্যন্ত অনেক কিছু জানা গেলেও এখনও সব রহস্যের জট ছাড়েনি। যেমন আমরা এখনো বুঝতে পারিনি কীভাবে একই ডিএনএ থেকে এত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কোষ তৈরি হয়—মস্তিষ্কের কোষ, হার্টের কোষ, চামড়ার কোষ। মানব জিনোম প্রকল্পের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়েছে যে আমাদের ডিএনএ-এর প্রায় ৯৮ শতাংশ প্রোটিন তৈরি করার কোড বহন করে না। এই নন-কোডিং অঞ্চলটিকেই বিজ্ঞানীরা জিনোমের ডার্ক ম্যাটার বা জাঙ্ক ডিএনএ বলেন। এর কাজ এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি। প্রায় ৯০ শতাংশ রোগ-সম্পর্কিত জেনেটিক পরিবর্তন এই নন-কোডিং অঞ্চলেই পাওয়া যায়। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো কীভাবে রোগ সৃষ্টি করে, তা এখনো পুরোপুরি অজানা। এই অঞ্চলে তৈরি হওয়া আরএনএ (যেমন: lncRNA, miRNA) প্রোটিন তৈরি না করলেও কোষের ভেতরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। এদের প্রত্যেকের সঠিক কাজ কী, তা এখনো রহস্যে মোড়া।

আরও পড়ুন
গত দশকে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী। একইভাবে ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন বিজ্ঞানী হাসিনা খানের নেতৃত্বে আমাদের দেশের একদল গবেষক।

এপিজেনেটিক্স নামে একটি নতুন শাখা আবিষ্কার করেছে যে আমাদের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস এমনকি অভিজ্ঞতাও প্রভাব ফেলতে পারে কোন জিন চালু বা বন্ধ থাকবে তার ওপর। আরও অবাক করা বিষয় হলো, এই পরিবর্তনগুলো কখনো কখনো পরবর্তী প্রজন্মেও চলে যায়। মানে, আপনার দাদার জীবনের অভিজ্ঞতা হয়তো প্রভাব ফেলছে আপনার জিনের ওপর। এই ব্যাপারগুলো এখনো পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয়নি। আবার জীবনের সূচনা ও জেনেটিক কোড কীভাবে কাজ শুরু করল, তা এখনো জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক ও গভীর রহস্য।

এই রহস্যগুলোর সমাধানের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের চিকিৎসা বিজ্ঞান, রোগ নিরাময় এবং জীবন সম্পর্কে আমাদের সামগ্রিক ধারণা। আগামী দিনের বিজ্ঞানীরা সেসব রহস্যের উদঘাটন করবে, আমরা সে অপেক্ষাতেই আছি।

সূত্র: ডিএনএ ডিমিস্টিফায়েড/ অ্যালান ম্যাকহুগেন

জিন ও ডিএনএ/ আইজ্যাক আসিমভ

নিউ সায়েন্টিস্ট

সায়েন্টিফিক আমেরিকান

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন