ভিটামিন বি আবিষ্কারের কাহিনি

উনিশ শতকের শেষ দিক। মানব ইতিহাসের এক বৈপ্লবিক সময়। এ সময়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি এবং সাহিত্যে এমন কিছু পরিবর্তন এসেছিল, যা গড়ে দিয়েছিল আধুনিক পৃথিবীর ভিত্তি। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন ও টমাস আলভা এডিসন ব্যবহারযোগ্য বৈদ্যুতিক বাল্ব উদ্ভাবন করেন এ যুগেই। আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু এ সময়েই বেতার তরঙ্গ বা রেডিও নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তাঁর কয়েক বছর পরেই গুগলিয়েলমো মার্কনি সূচনা করেন বেতার বা রেডিওর। আবার এ সময়েই কার্ল বেঞ্জ প্রথম পেট্রোলচালিত গাড়ি তৈরি করেন। সেটাই আধুনিক পরিবহনের সূচনা করে। তেমনি উইলহেলম রন্টজেন এক্স-রে আবিষ্কারও চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছিল।

এসব উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের পাশাপাশি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ একটি রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। রোগটির নাম বেরিবেরি। এতে আক্রান্ত হলে মানুষের হাত-পা ফুলে যেত, হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে যেত এবং স্নায়ুতন্ত্রে দেখা দিত মারাত্মক সব সমস্যা। আক্রান্ত অনেক রোগীই কিছুদিনের মধ্যে মারা যেত।

জাপান, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং ভারতীয় উপমহাদেশে এই রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে এশিয়ার যেসব অঞ্চলে প্রধান খাদ্য ছিল পরিশোধিত সাদা চাল, সেখানে এর প্রকোপ ছিল ভয়াবহ। কিন্তু এ রোগের কারণ বা চিকিৎসা সম্পর্কে সেকালে কেউ কিছু জানত না।

জাপানি নৌবাহিনীতে একসময় এই রোগ খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করে। ১৮৮০ সালের দিকে জাপানি নৌবাহিনীর হাজার হাজার নাবিক বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়। অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। সমস্যা সমাধানে জাপানি নৌবাহিনীর চিকিৎসক কানেহিরো তাকাকি একটা গবেষণা শুরু করেন।

আরও পড়ুন
বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু এ সময়েই বেতার তরঙ্গ বা রেডিও নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তাঁর কয়েক বছর পরেই গুগলিয়েলমো মার্কনি সূচনা করেন বেতার বা রেডিওর।

তাকাকি লক্ষ করেন, নৌবাহিনীর নাবিকরা প্রধানত পালিশ করা চাল খায়। তাঁর সন্দেহ হতে থাকে, এই খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে বেরিবেরি রোগের কোনো সম্পর্ক আছে। সেই সন্দেহ নিরসনে ১৮৮৪ সালে একটি পরীক্ষা চালান তিনি। পরীক্ষার শুরুতেই দুটি জাহাজ বেছে নেন। একটি জাহাজের নাবিকদের পালিশ করা চালের পরিবর্তে মিশ্র খাবার দেন তিনি। এই খাবারে ছিল গম, বার্লি, মাংস, মাছ ও সবজি। আরেকটি জাহাজের নাবিকদের আগের মতোই পালিশ করা চাল দেওয়া হয়।

কিছুদিন পর পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেল। সেই ফলাফল ছিল তাক লাগানো। তাকাকি দেখতে পান, যে জাহাজের নাবিকেরা মিশ্র খাবার খেয়েছিল, তাদের মধ্যে বেরিবেরি রোগ একেবারেই দেখা যায়নি। কিন্তু অন্য জাহাজের নাবিকেরা আগের মতোই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।

এ পরীক্ষার পর তাকাকি নিশ্চিত হন, বেরিবেরি রোগ কোনো সংক্রামক রোগ নয়, বরং খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ সিদ্ধান্তে আসার পর তিনি জাপানি নৌবাহিনীতে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেন। পালিশ করা চালের পরিবর্তে বার্লি এবং অন্যান্য খাবার দেওয়া শুরু হয়। ফলে নৌবাহিনীতে বেরিবেরি রোগ প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়ে যায়। কিন্তু একটা ব্যাপার তাকাকি উদ্‌ঘাটন করতে পারেননি। সেটা হলো খাদ্যের মধ্যে আসলে এমন কী আছে, যা বেরিবেরি রোগ হতে বাধা দেয়? সেটা এমন কোনো পদার্থ, যা পালিশ করা চালের মধ্যে নেই। কী সেটা?

আরও পড়ুন
তাকাকি দেখতে পান, যে জাহাজের নাবিকেরা মিশ্র খাবার খেয়েছিল, তাদের মধ্যে বেরিবেরি রোগ একেবারেই দেখা যায়নি। কিন্তু অন্য জাহাজের নাবিকেরা আগের মতোই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।

২.

১৮৯৭ সালের ঘটনা। আজকের ইন্দোনেশিয়া তখন নেদারল্যান্ডসের উপনিবেশ। দেশটির নাম ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। ডাচরা এই এলাকাকে নেদারল্যান্ডস ইন্ডিজ বা নেদারল্যান্ডস ইস্ট ইন্ডিজ নামেও ডাকত।

একবার এই অঞ্চলে এলেন নেদারল্যান্ডসের চিকিৎসক ক্রিস্টিয়ান আইকম্যান। তাঁর আসার উদ্দেশ্য বেরিবেরি রোগের কারণ খুঁজে বের করা। সেজন্য তিনি বেছে নেন জাভা দ্বীপ। সেখানেই গবেষণা শুরু করেন। আইকম্যান প্রথমে ভেবেছিলেন, এই রোগ কোনো জীবাণুর কারণে হয়। নিজের অনুমান যাচাই করতে কিছু পরীক্ষা চালাতে শুরু করেন তিনি। তখনই ঘটল এক আকস্মিক ঘটনা।

আইকম্যানের গবেষণাগারে কিছু মুরগি ছিল। হঠাৎ মুরগিগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ল। সেগুলোর পা দুর্বল হয়ে গেল। হাঁটতেও পারে না এমন অবস্থা। এই লক্ষণগুলোর সঙ্গে মানুষের বেরিবেরি রোগের মিল আছে। কিন্তু মুরগিগুলোর এরকম হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না।

কিছুদিন পর ঘটল আরেক কাণ্ড। দেখা গেল মুরগিগুলো সুস্থ হয়ে উঠছে। এতে অবাক হন আইকম্যান। এর পেছনের কারণ খুঁজতে শুরু করেন তিনি। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। সবশেষে জানা গেল, আগে মুরগিগুলোকে হাসপাতালের রান্নাঘর থেকে পালিশ করা চালের ভাত এনে খাওয়ানো হতো। কিছুদিন পর ওই হাসপাতালে নতুন রাঁধুনি এল। সেই রাঁধুনি খরচ বাঁচানোর জন্য পালিশ করা চালের বদলে মুরগিগুলোকে সস্তা, অপরিশোধিত লাল চাল খাওয়াতে শুরু করে। তাতেই কিছুদিনের মধ্যে মুরগিগুলো সুস্থ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন
একবার নেদারল্যান্ডস ইন্ডিজ অঞ্চলে এলেন নেদারল্যান্ডসের চিকিৎসক ক্রিস্টিয়ান আইকম্যান। তাঁর আসার উদ্দেশ্য বেরিবেরি রোগের কারণ খুঁজে বের করা। সেজন্য তিনি বেছে নেন জাভা দ্বীপ।

এই ঘটনাটি আইকম্যানের চিন্তা ও গবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি বুঝতে পারলেন, সমস্যাটা কোনো জীবাণুর সংক্রমণে নয়, বরং এর সমাধান লুকিয়ে আছে খাবারের মধ্যেই। আইকম্যান বুঝতে পারেন, পালিশ করা চাল এবং বেরিবেরি রোগের মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে। কিন্তু সম্পর্কটা কী?

ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আইকম্যান আরও পরীক্ষা চালান। তিনি একদল মুরগিকে পালিশ করা চাল দেন এবং অন্য মুরগিকে দেন সস্তা লাল চাল। কদিন পর দেখা গেল, যেসব মুরগি পালিশ করা চাল খেয়েছিল, সেগুলো বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলো।

কিন্তু যেগুলো লাল চাল খেয়েছিল, সেগুলো সুস্থ রইল। এই পরীক্ষার পর আইকম্যান একেবারে নিশ্চিত হন যে, চাল পালিশ করার সময় এমন কিছু সরিয়ে ফেলা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আইকম্যান ১৯০৭ সালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করেন। চালের কুঁড়া দিয়ে একটি নির্যাস তৈরি করেন তিনি। এই নির্যাস বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত মুরগিদের খাওয়ালে সেগুলো সুস্থ হয়ে ওঠে। এই আবিষ্কারের পর আইকম্যান বুঝতে পারেন, চালের কুঁড়ায় এমন কিছু পদার্থ আছে যা বেরিবেরি রোগ প্রতিরোধ করে। এটুকুই। কিন্তু সেটা কী পদার্থ, তা উদ্‌ঘাটন করতে পারেননি আইকম্যান। গবেষণাটা অসমাপ্ত রয়ে গেল বেশ কয়েক বছর।

আরও পড়ুন
আইকম্যান ১৯০৭ সালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করেন। চালের কুঁড়া দিয়ে একটি নির্যাস তৈরি করেন তিনি। এই নির্যাস বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত মুরগিদের খাওয়ালে সেগুলো সুস্থ হয়ে ওঠে।

৩.

আইকম্যানের অসমাপ্ত গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যান পোল্যান্ডের বিজ্ঞানী কাজিমির ফাঙ্ক। ১৯১২ সালে চালের কুঁড়া থেকে একটি বিশেষ পদার্থ আলাদা করেন তিনি। পদার্থটি খুবই অল্প পরিমাণে দরকার, কিন্তু এটি ছাড়া বেরিবেরি রোগ হয়।

পরে এই পদার্থটি ভিটামিন বি নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তিনি এর রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে দেখেন, এতে অ্যামাইন বা অ্যামিন (Amine) নামে একটি নাইট্রোজেন গ্রুপ রয়েছে। ফাঙ্ক এই পদার্থের নাম দেন ভিটামিন। যেহেতু এই পদার্থটি জীবনের জন্য অপরিহার্য, তাই তিনি ল্যাটিন শব্দ ভিটা এবং অ্যামাইন মিলিয়ে এর নাম দেন ভিটামিন (Vitamine)। ভিটা অর্থ জীবন। সেটাই পরে Vitamin নামে পরিচিতি পায়।

ফাঙ্ক আরও গবেষণা করে দেখেন, এই ভিটামিন শুধু চালের কুঁড়ায় নয়, বরং অন্য খাবারেও আছে। খোসাসহ দানাশস্য, মাংস, মাছ, দুধ, ডিম এবং সবুজ শাকসবজিতে এই ভিটামিন পাওয়া যায়। তিনি বুঝতে পারেন, যেসব মানুষ শুধু পালিশ করা চাল খায়, তাদের এই ভিটামিনের অভাব হয়। ফাঙ্কই প্রথম প্রস্তাব করেন, বেরিবেরির মতো আরও অনেক রোগ, যেমন স্কার্ভি, পেলেগ্রা ইত্যাদি নির্দিষ্ট কিছু অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানের অভাবেই হয়।

জার্মান বিজ্ঞানী রিচার্ড কুহন ১৯১৬ সালে আবিষ্কার করেন, ভিটামিন বি আসলে একটি নয় বরং একাধিক যৌগের সমষ্টি। প্রতিটি যৌগের আলাদা আলাদা কাজ আছে। এই আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা ভিটামিন বি কমপ্লেক্স নামে একটি পরিবারের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন। এক দশক পর নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী বারেন্ড ইয়ানসেন এবং উইলিয়াম ডোনাথ প্রথম ভিটামিন বি১ বা থায়ামিন আলাদা করতে সফল হন। তাঁরা চালের কুঁড়া থেকে একটি স্ফটিক পদার্থ তৈরি করেন, যা বেরিবেরি রোগ সারাতে পারে। এই আবিষ্কার ভিটামিন বি গবেষণায় একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। ১৯৩৬ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট উইলিয়ামস থায়ামিনের সম্পূর্ণ রাসায়নিক গঠন বের করেন। তিনি দেখেন, এই জটিল যৌগের মধ্যে সালফার, নাইট্রোজেন এবং অন্য উপাদান আছে। এই আবিষ্কারের পর কৃত্রিমভাবে থায়ামিন তৈরি করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুন
পোল্যান্ডের বিজ্ঞানী কাজিমির ফাঙ্ক ১৯১২ সালে চালের কুঁড়া থেকে একটি বিশেষ পদার্থ আলাদা করেন তিনি। পদার্থটি খুবই অল্প পরিমাণে দরকার, কিন্তু এটি ছাড়া বেরিবেরি রোগ হয়।

এর পরের বছর বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় আরেকটি ভিটামিন বি আবিষ্কার করেন। সেটি ছিল রিবোফ্লাভিন বা ভিটামিন বি২। এই ভিটামিন দুধ, ডিম ও সবুজ শাকসবজিতে পাওয়া যায়। এই ভিটামিনের অভাবে মুখের কোণে ঘা, জিভে প্রদাহ এবং চোখে জ্বালাপোড়া হয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবিষ্কৃত হয় তৃতীয় ভিটামিন বি। এর নাম নিয়াসিন বা ভিটামিন বি৩। এই ভিটামিনের অভাবে পেলাগ্রা নামক একটি রোগ হয়। এই রোগে চামড়ায় দাগ, ডায়রিয়া ও মানসিক বিকার দেখা যায়। এককালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে এই রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৯৪০ সালে আবিষ্কৃত হয় প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড বা ভিটামিন বি৫। এটি আবিষ্কার করেন মার্কিন বিজ্ঞানী রজার উইলিয়ামস। এই ভিটামিন শক্তি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রায় সব খাবারে পাওয়া যায়, তাই এর অভাব খুব কম হয়। পাইরিডক্সিন বা ভিটামিন বি৬ আবিষ্কৃত হয় ১৯৪৩ সালে। এই ভিটামিন প্রোটিন বিপাকে সাহায্য করে। মাংস, মাছ, আলু ও কলায় এই ভিটামিন পাওয়া যায়। এর অভাবে স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যা এবং রক্তশূন্যতা দেখা যায়।

আর ভিটামিন বি১২ আবিষ্কৃত হয় ১৯৪৮ সালে। এটি আবিষ্কার করেন মার্কিন বিজ্ঞানী কার্ল ফোলকারস এবং তাঁর সহকর্মীরা। এই ভিটামিন আবিষ্কারের গল্প খুবই রোমাঞ্চকর। তাঁরা দেখেছিলেন, রক্তশূন্যতার বিশেষ একটি ধরন বেশ মারাত্মক। এই রোগের নাম পারনিসিয়াস অ্যানিমিয়া। এতে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত মারা যায়। কিন্তু ডাক্তাররা পরীক্ষায় দেখতে পান, রোগীদের কলিজা খাওয়ালে তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, কলিজায় এমন কিছু আছে, যা এই রোগ সারায়। দীর্ঘ গবেষণার পর কলিজা থেকে একটি লাল রঙের স্ফটিক তৈরি করা সম্ভব হয়। দেহের জন্য এ পদার্থটি খুবই অল্প পরিমাণে দরকার, কিন্তু এটি ছাড়া রক্তশূন্যতা সারে না।

আরও পড়ুন
১৯৪০ সালে আবিষ্কৃত হয় প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড বা ভিটামিন বি৫। এটি আবিষ্কার করেন মার্কিন বিজ্ঞানী রজার উইলিয়ামস। এই ভিটামিন শক্তি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ।

ভিটামিন বি১২ আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা দেখেন, এটি শুধু রক্তশূন্যতা সারায় না বরং স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই ভিটামিনের বিশেষত্ব হলো, এটি শুধু প্রাণিজ খাবারে পাওয়া যায়। উদ্ভিজ্জ খাবারে এই ভিটামিন নেই। তাই নিরামিষাশীদের এই ভিটামিনের অভাব হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ভিটামিন বি৯ বা ফলিক অ্যাসিড আবিষ্কৃত হয় ১৯৪১ সালে। এই ভিটামিন কোষ বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সন্তানসম্ভবা নারীদের জন্য এই ভিটামিন খুবই প্রয়োজনীয়। এর অভাবে গর্ভের শিশুর জন্মগত ত্রুটি হতে পারে। পালং শাক, ব্রকলি এবং অন্যান্য সবুজ শাকসবজিতে এই ভিটামিন পাওয়া যায়। ১৯৫০ সালে বায়োটিন বা ভিটামিন বি৭ আবিষ্কার হয়। এই ভিটামিন চর্বি ও কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা বিপাকে সাহায্য করে। ডিম, বাদাম ও বীজে এই ভিটামিন পাওয়া যায়। এর অভাব খুবই কম হয়, কারণ আমাদের পেটের ভেতরের উপকারী জীবাণুরা এই ভিটামিন তৈরি করতে পারে।

১৯৬০ সালের পর বোঝা গেল, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আমাদের শরীরের শক্তি উৎপাদনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। এই ভিটামিনগুলো আমাদের খাবারকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এ ছাড়া এগুলো স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত তৈরি এবং ডিএনএ সংশ্লেষণে কাজ করে। এরপর বিজ্ঞানীরা আরও জানতে পারেন, ভিটামিন বি একে অপরের সঙ্গে মিলে কাজ করে। একটি ভিটামিন বি-এর অভাব হলে অন্যগুলোর কাজকারবারেও সমস্যা দেখা দেয়। তাই চিকিৎসকেরা সাধারণত ভিটামিন বি কমপ্লেক্স হিসেবে সবগুলো ভিটামিন বি একসঙ্গে খাওয়ার পরামর্শ দেন।

আরও পড়ুন
১৯৫০ সালে বায়োটিন বা ভিটামিন বি৭ আবিষ্কার হয়। এই ভিটামিন চর্বি ও কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা বিপাকে সাহায্য করে। ডিম, বাদাম ও বীজে এই ভিটামিন পাওয়া যায়।

গত শতকের ৮০-এর দশকে এসে জানা গেল, ভিটামিন বি১২ এবং ফলিক অ্যাসিড হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই দুই ভিটামিন রক্তে হোমোসিস্টিন নামে একটি ক্ষতিকারক পদার্থের পরিমাণ কমায়। উচ্চ হোমোসিস্টিন হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আরও পরে গবেষকেরা দেখতে পান, গর্ভবতী নারীরা যদি গর্ভধারণের আগে এবং গর্ভাবস্থায় ফলিক অ্যাসিড খান, তাহলে তাদের শিশুদের স্পাইনা বিফিডা নামে জন্মগত ত্রুটি হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। এই আবিষ্কারের পর অনেক দেশে আটায় ফলিক অ্যাসিড যোগ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। চলতি শতকের গোড়ার দিকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। থায়ামিনের, রিবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি৬ এবং ভিটামিন বি১২-এর অভাব হলে বিষণ্নতা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং অন্য মানসিক সমস্যা দেখা যায়।

ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার
ছবি: ফ্রিপিক

এখন আমরা জানি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভিটামিনগুলো পানিতে দ্রবণীয়, তাই এগুলো শরীরে জমা থাকে না। প্রতিদিন এই ভিটামিনগুলো খাবারের মাধ্যমে নিতে হয়। ভিটামিন বি-এর ভালো উৎস হলো পুরো দানাশস্য, মাংস, মাছ, দুধ, ডিম, বাদাম, বীজ ও সবুজ শাকসবজি।

ভিটামিন বি আবিষ্কারের এই দীর্ঘ যাত্রায় অনেক বিজ্ঞানী পরিশ্রম করেছেন। তাকাকির পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে আইকম্যানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ফাঙ্কের নামকরণ এবং পরে বিজ্ঞানীদের বিস্তারিত গবেষণা—সবকিছু মিলে আজ আমরা ভিটামিন বি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পেয়েছি।

 

সূত্র: আইজ্যাক আসিমভের হাউ উই নো অ্যাবাউট ভিটামিনস ও  উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন