সুপারহিরোর বিজ্ঞান
স্পাইডার-ম্যানের গুয়েন স্টেসির আসল হত্যাকারী কে: একটি বৈজ্ঞানিক তদন্ত!
অ্যামেইজিং স্পাইডার-ম্যান মুভির সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটির কথা মনে আছে? পড়ে যাচ্ছে স্পাইডার-ম্যানের বান্ধবী গুয়েন স্টেসি, এবং স্পাইডার-ম্যান জাল ছুড়ে দিয়েছে… ধরে ফেলল মেয়েটিকে, অথচ শেষ রক্ষা হলো না। কমিকসেও আছে এই ঘটনা। তর্ক সাপেক্ষে এটিকে বলা হয় স্পাইডার-ম্যানের সেরা কমিকস। বাঞ্জি জাম্পিংয়ের সময়ও প্রায় কাছাকাছিভাবে লাফিয়ে পড়েন অনেক মানুষ। দুটি ঘটনার পার্থক্য কী? গুয়েন স্টেসির মৃত্যুরহস্যের বৈজ্ঞানিক তদন্ত, পদার্থবিজ্ঞানের চোখে…
মার্ভেল কমিকসের সুপারহিরো চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি চরিত্র স্পাইডার-ম্যান। কেউ কেউ একে মার্ভেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রও বলেন। ১৯৬২ সালে স্ট্যান লি এবং স্টিভ জিটকোর হাত ধরে আবির্ভূত হয় এটি।
এই কমিক বইয়ের মূল নায়ক তরুণ পিটার পার্কার। ছেলেটা সে অন্য আট-দশটা তরুণের মতোই সাধারণ। আপাদমস্তক পড়ুয়া, চলতি ইংরেজিতে যাকে বলে ‘নার্ড’। তার স্কুল-জীবন একরকম বিষিয়ে উঠেছিল বখাটে সহপাঠীদের অত্যাচারে। তাই অন্য সাধারণ কিশোরদের মতো পার্টি বা খেলাধূলায় টিকতে না পেরে সে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিল বিজ্ঞান চর্চায়। সময় পেলেই ঘুরতে চলে যেত বিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে। আবার সুযোগ পেলে বিভিন্ন গবেষণাগারেও ঘুরতে যেত, দেখত অদ্ভুত সব এক্সপেরিমেন্ট। এমনই এক গবেষণাগার আয়োজিত প্রদর্শনীতে ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। একটি বিশেষ ধরনের মাকড়সা কামড়ে দেয় পিটার পার্কারকে। মাকড়সাটির ওপর চালানো হয়েছিল এক্সপেরিমেন্ট। ফলে জিন বদলে গিয়ে সেটি হয়ে উঠেছিল তেজস্ক্রিয়। এই তেজস্ক্রিয় রক্ত দেহে প্রবেশের পরেই দ্রুত পাল্টে যায় পিটার, পরিণত হয় স্পাইডার-ম্যানে।
বাহ্যিক কোনো পরিবর্তন না এলেও শারীরিক সক্ষমতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে পিটার পার্কারের। নিমিষেই তুলে ফেলতে পারে নিজের শরীরের চেয়ে কয়েক গুণ ভারী বস্তু। ইন্দ্রিয়গুলোর কার্যকারিতা বেড়ে যায় বহু গুণ। পাশাপাশি মাকড়সার মতো যেকোন খাড়া দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে যাওয়ার ক্ষমতাও আয়ত্তে চলে আসে।
স্ট্যান লি এই সুপারহিরোর অতিমানবীয় ক্ষমতাগুলো সাজিয়েছিলেন মাকড়সার সঙ্গে মিল রেখে। তবে এক জায়গায় বেশ মৌলিক অমিলও রেখে দিয়েছিলেন। মাকড়সার মতো করে পিটার পার্কার নিজের দেহের ভেতরে জাল তৈরি করতে পারত না। বরং প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এই তরুণ উদ্ভাবক তৈরি করেছিল একধরনের ‘ওয়েব শ্যুটার’। সেটি আটকানো থাকত তার কব্জিতে। এই শ্যুটার ব্যবহার করেই সে ছুঁড়ে মারতে পারত মাকড়সার মতো জাল।
অবশ্য ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া স্পাইডার-ম্যান মুভিতে বদলে দেওয়া হয় বিষয়টি। দেখানো হয়, বড় পর্দার স্পাইডার-ম্যানের দেহের ভেতরেই তৈরি হচ্ছে জাল। এই জাল সে সরাসরি ছুড়ে দিতে পারত হাত থেকে। কোনো ওয়েব শ্যুটারের প্রয়োজন পড়ত না। মূল কমিক বইয়ের বাইরে গিয়ে এমন পরিবর্তনের পেছনে ছবি নির্মাতাদের অবশ্য বেশ জোরালো যুক্তি ছিল। কমিক বইয়ে বর্ণনা করা সময়ে অল্প বয়সী দরিদ্র এক কিশোরের পক্ষে কোনোভাবেই এরকম উন্নত ও ব্যয়বহুল ওয়েব শ্যুটার যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে হালের তুমুল জনপ্রিয় মার্ভেলের অ্যাভেঞ্জার সিরিজের মুভিগুলোতে স্পাইডার-ম্যানের হাতে আবারও ফিরে এসেছে ওয়েব শ্যুটার। ধনকুবের টনি স্টার্কের তথা আয়রনম্যানের বদৌলতে এর আর্থিক ও প্রযুক্তিগত দিকটি ব্যাখ্যা করতে এবারে মোটেও বেগ পেতে হয়নি নির্মাতাদের।
স্পাইডার-ম্যান সিরিজের ভিলেনরা কিন্তু বেশ বৈচিত্র্যময়। গ্রিন গবলিন, ডক্টর অক্টোপাস, স্যান্ডম্যানের মতো শক্তিশালী ভিলেনদের সঙ্গে টেক্কা দিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তরুণ পিটার পার্কারকে। তাদের ধূর্ত কৌশলের কারণে সুপারপাওয়ার নিয়েও অনেক সময় বিশেষ সুবিধা করতে পারত না সে। ভিলেনদের মধ্যে গ্রিন গবলিনের সঙ্গে স্পাইডার-ম্যানের দ্বৈরথ পাঠক/দর্শকের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে। কারণ এ সংঘাতের একপর্যায়ে করুণভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছিল পিটার পার্কারের বান্ধবী স্টেসিকে। কীভাবে ঘটেছিল সেই ঘটনা?
২.
অ্যামেইজিং স্পাইডার-ম্যান সিরিজের গল্পের এক পর্যায়ে গ্রিন গবলিন হদিশ পেয়ে যায় স্পাইডার-ম্যান নামের আড়ালে থাকা পিটার পার্কারের। নিমিষেই সে জেনে ফেলে পিটারের সব প্রিয়জনের পরিচয়। এর সূত্র ধরে সে অপহরণ করে পিটারের বান্ধবী স্টেসিকে। তাকে আটকে রাখে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজের চূড়ায়। অবধারিতভাবেই প্রিয়তমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে স্পাইডার-ম্যান। বেঁধে যায় তুমুল লড়াই। এক পর্যায়ে গ্রিন গবলিন ব্রিজের চূড়া থেকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দেয় স্টেসিকে। তাকে বাঁচাতে স্পাইডার-ম্যান ব্যবহার করে ওয়েবিং। অর্থাৎ ওয়েব শ্যুটার থেকে জাল ছুড়ে দিয়ে পানিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলতে সক্ষম হয় স্টেসিকে। কিন্তু না, তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। জাল গুটিয়ে স্টেসিকে ওপরে তোলার পর পিটার টের পায়, স্টেসি আর নেই। অ্যামেইজিং স্পাইডার-ম্যান ২ মুভির শেষে এই দৃশ্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল দর্শকদের। আর পাঠকের জন্য মূল কমিকের পাতায় চিত্রিত সেই হৃদয় বিদারক ঘটনার ছবি এখানে যুক্ত করে দিচ্ছি (ছবি ২.১ ও ছবি ২.২)।
প্রিয় পাঠক, কমিকের দ্বিতীয় পাতার শেষ অংশে গ্রিন গবলিনের সংলাপটা লক্ষ্য করেছেন? ‘এ ফল ফ্রম দ্যাট হাইট উড কিল এনিওয়ান—বিফোর দে স্ট্রাক দ্য গ্রাউন্ড!’ অর্থাৎ এত উঁচু থেকে পড়ে গেলে মাটিতে ধাক্কা খাওয়ার আগেই মৃত্যু অবধারিত! কমিক বইয়ের লেখকেরা যে মাঝেমধ্যেই বিজ্ঞানের বারোটা বাজিয়ে দেন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই সংলাপ। অনেক ওপর থেকে পড়ে গেলে বা লাফ দিলেই (মাটি বা অন্য কিছু স্পর্শ করার আগে) যদি কেউ মারা যেত, তাহলে প্যারাট্রুপাররা কোটি টাকার বিনিময়েও প্লেন থেকে লাফ দিতেন না। শখের বসে বা রোমাঞ্চের সন্ধানে স্কাই ডাইভিং করা অথবা বাঞ্জি জাম্পিংয়ে অংশ নেওয়া সবারই মৃত্যু হতো।
গ্রিন গবলিনের সংলাপ যে সম্পূর্ণ ভূল, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এটিকে আপাতত উপেক্ষা করলেও পুরো ঘটনা নিয়ে বেশ কটি প্রশ্ন থেকেই যায়। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো— ‘মাটি বা পানি স্পর্শ করার আগে স্পাইডার-ম্যানের জালে আটকা পড়লেও স্টেসি মারা গেল কেন?’ উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাওয়া অবস্থায় কেউ মারা যায় না, বরং তেমনটা ঘটতে পারার কথা কেবল ভূমি বা পৃষ্ঠ স্পর্শ করার পরে। তবে কি সংলাপের মতো এখানেও ভুল করলেন কমিক বইয়ের লেখকেরা?
৩.
স্টেসির মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে আমাদের দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। এক, স্পাইডার-ম্যানের ছুঁড়ে দেওয়া জাল স্টেসিকে স্পর্শ করার মুহূর্তে সে কত বেগে নিচের দিকে পড়ছিল? আর দুই, স্টেসির পতন থামাতে গিয়ে তার ওপর ঠিক কী পরিমাণ বল প্রয়োগ করা হয়েছিল?
উত্তর খুঁজতে আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে স্যার আইজ্যাক নিউটনের। প্রয়োগ করতে হবে বিখ্যাত গতির সমীকরণগুলো। ধরা যাক, জাল স্পর্শ করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত স্টেসি ব্রিজের টাওয়ার চূড়া থেকে মাটির দিকে প্রায় ৩০০ ফিট বা ৯০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে। তাহলে নিউটনের গতির চতুর্থ সমীকরণ ব্যবহারে সেই সময়ের শেষ বেগ পাওয়া যাবে এমন—
v2 = u2 + 2gh
বা, v2 = (0)2 + 2 × (9.8) × (90)
v = 42 ms-1
বাতাসের বাধাকে হিসাবের মধ্যে নিলে প্রকৃত শেষবেগের মান সামান্য কম হবে। তবে আপাতত সেটিকে উপেক্ষা করলেও তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। যা-ই হোক, প্রতি সেকেন্ডে ৪২ মিটার করে নিচে পড়ে যাওয়া স্টেসিকে রক্ষা করতে হলে অবধারিতভাবেই গতিবেগের মান নামিয়ে আনতে হবে শূন্যের কোঠায়। আর সে জন্য প্রয়োগ করতে হবে গতির বিপরীত দিকে বাহ্যিক বল। স্পাইডার-ম্যানের ওয়েবিং যোগান দেবে এ বলের। বলের মান যত বেশি হবে, তত দ্রুত থামানো সম্ভব হবে স্টেসিকে। এটির মান নিখুঁতভাবে জানতে হলে আমাদের ব্যবহার করতে হবে নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্র থেকে প্রাপ্ত সমীকরণ, F = ma। সহজে ব্যবহারের জন্য চাইলে আমরা সমীকরণটিকে একটু ভিন্নভাবে সাজিয়ে নিতে পারি—
F = ma = m (v-u/t)
যাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে, তাদের জন্য একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমরা জানি, বেগের পরিবর্তনের হার ত্বরণ। ধরা যাক, কোনো বস্তু ১০ মিটার/সেকেন্ড নিয়ে চলা শুরু করল। ৫ সেকেন্ড পরে সেটির বেগ পৌছাল ২০ মিটার/সেকেন্ডে। তাহলে এই সময়ে বেগের পরিবর্তন হলো (২০-১০) বা ১০ মিটার/সেকেন্ড। একক সময়ে বেগের পরিবর্তন বা ত্বরণ হবে (২০-১০ / ৫) বা ২ মিটার/সেকেন্ড২। এখন স্যাংখিক মানের পরিবর্তে প্রতীক দিয়ে ওপরের পুরো হিসাবটি প্রকাশ করলে কেমন হবে? ধরুন, যাত্রা শুরুর বেগকে u, শেষ বেগকে v এবং সময়কে t দিয়ে প্রকাশ করলে ত্বরণ হবে—
a = (v-u/t)
একেই ওপরের সমীকরণে ব্যবহার করা হয়েছে।
চলুন, এবারে আর দেরি না করে স্টেসির পতন থামাতে ক্রিয়াশীল বলের মান হিসাব করে ফেলা যাক। সমীকরণ অনুযায়ী আমাদের আগে থেকেই জানতে হবে স্টেসির ভর, শুরুর বেগ বা আদি বেগ, শেষ বেগ এবং বল ক্রিয়াশীল থাকার সময়কাল। বেগের মান দুটি কিন্তু আমরা আগেই হিসাব করে বের করে ফেলেছি। অবশিষ্ট রাশি দুটিকে আপাতত আমাদের অনুমান করে নিতে হবে। এভাবে একদম সঠিক না হলেও বেশ কাছাকাছি ফলাফল পাওয়া যাবে। ধরা যাক, স্টেসির ভর ৫০ কেজি এবং বল ক্রিয়ারত থাকার সময়কাল ০.৫ সেকেন্ড। অর্থাৎ খুব অল্প সময় ব্যবধানে ওয়েবিংয়ের মাধ্যমে স্পাইডার-ম্যান স্টেসির পতন রোধ করতে সমর্থ হয়। তাহলে বলের মান দাঁড়াবে—
F = 50 × (42 - 0) / 0.5 = 4200 N
প্রিয় পাঠক, ওজন বের করার সমীকরণটি জানা আছে না? সেটি (W = mg) ব্যবহার করে স্টেসির ওজন চটপট বের করে ফেলুন তো! কত পেলেন? ৪৯০ নিউটন, তাই না? অর্থাৎ স্টেসিকে থামাতে যে বল প্রয়োগ করা হয়েছিলো, তা ছিল স্টেসির নিজস্ব ওজনের চেয়েও ৮ গুণ বেশি। এই বিপুল বল প্রয়োগের দরুন শরীরের যেকোনো স্পর্শকাতর অঙ্গ ভেঙ্গে গিয়ে নিমিষে মৃত্যুবরণ করা মোটেই অসম্ভব নয়। যদি একটু আগে দেওয়া মূল কমিকের প্রথম ছবির শেষাংশ ভালো করে লক্ষ করেন, দেখবেন, জাল দিয়ে স্টেসিকে থামানোর মুহূর্তেই একটি অদ্ভুত শব্দের (SWIK) কথা লেখকেরা লিখেছেন। স্টেসির ঘাড় ভেঙ্গে যাওয়ার দরুন এটির উৎপত্তি হতে পারে। তাই এ মৃত্যুর ঘটনাটি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গ্রিন গবলিনের ভুল সংলাপ এবং স্টেসির করুণ মৃত্যুর ঘটনার জন্য আমরা লেখকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করতেই পারি, কিন্তু বিজ্ঞানের সঠিক প্রয়োগের জন্য আমাদের কাছে থেকে দুই-একটা প্রশংসাসূচক বাক্য তাঁরা আশা করতেই পারেন, তাই না?
অবশ্য একটা কথা না বললেই নয়। যে মাত্রার বলের প্রয়োগের ফলে স্টেসির জীবনাবসান ঘটেছে, বাস্তবে তার চেয়েও অনেক বেশি মানের বল প্রয়োগের পরেও বেঁচে থাকার নজির আছে। ১৯৫৪ সালে বিশেষভাবে তৈরি একটি পরীক্ষামূলক রকেটসদৃশ গাড়িতে চেপে যাত্রা শুরু করেছিলেন কনওয়েল জন স্ট্যাপ। সেই সময়ে তাঁর দেহের ওপরে নিজ ওজনের চেয়েও ৪০ গুণ বেশি ভর ক্রিয়ারত ছিল। তাতেও তিনি মারা যাননি। তখন অবশ্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই তাঁকে যন্ত্রটিতে ওঠানো হয়েছিল। স্টেসির মতো অতর্কিত ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া বা অতিস্বল্প সময়ে নিরাপত্তা উপকরণ ছাড়াই থামানোর ঘটনা ঘটেনি।
প্রিয় পাঠক, এবারে একটু ভাবুন তো! ওয়েবিংয়ের মাধ্যমে পতন না থামিয়ে স্টেসিকে পানিতে পড়তে দিলেই কি বেশি ভালো হতো? তখন কি বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকত? উত্তর হলো, না। আসলে অনেক উঁচু থেকে পড়ার দরুন স্টেসির বেগ বড্ড বেশি বেড়ে গিয়েছিল। তাই সরাসরি পানিতে পড়লেও খুব সামান্য সময়ের ব্যবধানে তার বেগ নেমে আসত শূন্যের ঘরে। ফলে আগের মতোই ক্রিয়াশীল বলের মানও অনেক বেশি হতো। অর্থাৎ বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
মুভিতে হর-হামেশাই বেশ উঁচু দিয়ে উড়তে থাকা প্লেন থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়া মানুষদেরও দিব্যি বেঁচে থাকতে দেখা যায়। বাস্তবে এমনটা একরকম অসম্ভব। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এসব ক্ষেত্রে পানিতে পড়া বা মাটিতে আঘাত করার মাঝে আদতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
৪.
খানিক আগে আমরা বাঞ্জি জাম্পিংয়ের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? এগুলোতে অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়া ব্যক্তির সঙ্গে কোনো প্যারাসুট থাকে না। কেবল পায়ে বা শরীরে বাঁধা থাকে একটি শক্তপোক্ত দড়ি। মাটিতে পতনের আগেই সেটিতে টান লেগে ব্যক্তির পতন রোধ হয়। পুরো ব্যাপারটি অনেকটা স্টেসির ঘটনার মতোই। পার্থক্য কেবল, পতন রোধের উপকরণে; অর্থাৎ জালের পরিবর্তে দড়ি। স্বস্তির বিষয় হলো, বাঞ্জি জাম্পিংয়ের সময়ে মৃত্যু তো দূরের কথা, সাধারণত কারো সামান্যতম শারীরিক ক্ষতি পর্যন্ত হয় না। মাঝ থেকে মানুষ লাভ করে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা। দুটি ঘটনা প্রায় কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও ফলাফলে এত ভিন্নতার রহস্য কী?
প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রে। একটু ভিন্ন রূপে উপস্থাপিত নিউটনের সূত্রটি আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি,
F = m (v-u/t)
বা, F t = m (v-u)
অর্থাৎ, বল × সময় = ভর ×(বেগের পরিবর্তন)
এই নিরীহ দর্শন সমীকরণের মাঝে একটি চমকপ্রদ বিষয় লুকিয়ে আছে। সেটি হলো, কোনো নির্দিষ্ট ভরের বস্তুর বেগের পরিবর্তন কেবল প্রয়োগকৃত বলের মানের ওপর নির্ভর করে না, বরং এটির প্রয়োগের সময়কালের ওপরেও নির্ভরশীল। অর্থাৎ একই পরিমাণ বেগের পরিবর্তন দুভাবে করা যেতে পারে। অল্প সময়ে অনেক বেশি মানের বল প্রয়োগ করে অথবা বেশি সময় নিয়ে কম মানের বল প্রয়োগ করে। ওপরের সমীকরণ অনুসারে, বল এবং সময়ের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক বলেই এমনটা হতে পারে। এখানেই লুকিয়ে আছে বাঞ্জি জাম্পিংয়ের রহস্য। লাফ দেওয়ার সময়ে ব্যক্তির পায়ে বিশেষ ধরনের দড়ি বাঁধা থাকে, যা টান লাগলে প্রসারিত হতে পারে। তাই পতন রোধের সময়ে বল প্রয়োগের সময়কাল তুলনামূলক বেশ দীর্ঘ হয়। ফলে মাত্রই উল্লেখ করা ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে আসে বলের মান। এই কম মাত্রার বল দেহের ওপর তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে না। অন্যদিকে স্টেসির পতনের ঘটনায় বল প্রয়োগের সময়কাল ছিল খুব কম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলের মান ছিল অনেক বেশি। যদি বাঞ্জি জাম্পিংয়ের মতো করে স্টেসির পতনও বেশি সময় নিয়ে থামানো যেত, তাহলে সেও বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকতে পারত। অর্থাৎ কেবল অতিমানবীয় ক্ষমতা থাকলেই চলবে না, সত্যিকারের সুপারহিরো হতে হলে ফিজিকসটাও ভালোভাবে জানা থাকা চাই!
আরেকটি বিকল্প উপায়ে বাঁচানো সম্ভব ছিল স্টেসিকে। তবে সেটি ঠিকঠাক প্রয়োগ করা মোটেও চাট্টিখানি কাজ নয়। এই পদ্ধতিতে প্রথমেই ওয়েবিংয়ের মাধ্যমে পতন থামানোর চেষ্টা করা যাবে না। বরং স্পাইডার-ম্যানকে স্টেসির পিছুপিছু ব্রিজ থেকে নিচে লাফ দিতে হবে। খানিকটা দেরি করে যাত্রা শুরু করলেও স্টেসির কাছে পৌঁছাতে তেমন একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ আমাদের সুপারহিরো মিশন শুরু করবে বেশ ভালোরকম আদিবেগ নিয়ে। আর গন্তব্যে পৌঁছানোর পরে স্পাইডার-ম্যানকে নিজের বেগ কমিয়ে আনতে হবে। এর মান হতে হবে একদম স্টেসির সমান। যখন উভয়েই পরস্পরের সাপেক্ষে প্রায় একই বেগ নিয়ে চলমান থাকবে, কেবল তখনই সে স্টেসিকে স্পর্শ করবে এবং ওয়েবিং ব্যবহার করে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাবে। এই সময়ে বেগের পরিবর্তনজনিত ক্রিয়াশীল বলের ধাক্কার পুরোটাই সামলে নেমে স্পাইডার-ম্যানের হাত। পরের ছবিতে (ছবি ৫) বিষয়টি সহজে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ছবিটি নেওয়া হয়েছে স্পাইডার-ম্যান আনলিনিটেড সিরিজের ২ নং ইস্যু থেকে। সেখানে মাত্রই বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক উঁচু বিল্ডিং থেকে দুর্ঘটনাবশত পড়ে যাওয়া এক হতভাগ্য শ্রমিকের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয় স্পাইডার-ম্যান। আবার, ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া স্পাইডার-ম্যান মুভিতেও অনেকটা এভাবেই মেরি জেন ওয়াটসনের জীবন বাঁচায় পিটার পার্কার। পুনরায় পদ্ধতিটির প্রয়োগ দেখা যায় ২০২১ সালে মুক্তি পাওয়া মার্ভেলের স্পাইডার-ম্যান: নো ওয়ে হোম মুভিতে।
প্রিয় পাঠক, সুপারহিরো কমিক বই ও সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক ঘটনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হলো এই। এবার চূড়ান্ত বিচারের পালা। কে সত্যিকার অর্থে স্টেসির মৃত্যুর পেছনে দায়ী—সুপারভিলেন গ্রিন গবলিন নাকি স্পাইডার-ম্যান নিজেই?
সেই সিদ্ধান্ত নাহয় আপনি নিজেই নিন।
