জুলাই মাসে বিজ্ঞান জগতে নতুন কী ঘটল, দেখে নিন একনজরে

প্রতিদিন বিজ্ঞানের জগতে ঘটছে নানা ঘটনা। প্রতিমুহূর্তে এগোচ্ছে পৃথিবী, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন গবেষণাপত্র, জানা যাচ্ছে নতুন গবেষণার কথা। কিছু বিষয় এত সুদূর প্রসারী যে এগুলোর প্রভাব বোঝা যাবে আরও অনেক পরে। এরকম নানা বিষয়, নানা ঘটনা দেখে নিন একনজরে, জেনে নিন সংক্ষেপে।

১. খোঁজ মিলেছে পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলার

পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের গ্রহের চেহারা অনেক বদলে গেছে। পাহাড় তৈরি হয়েছে, আবার ভেঙেও গেছে। মহাদেশগুলোও তাদের জায়গা পরিবর্তন করেছে। এত কিছুর পরেও কিছু শিলা আজও টিকে আছে। যদিও শিলা বা পাথর জীবন্ত নয়, তবুও পৃথিবীর নিরন্তর পরিবর্তন থেকে সেগুলোও রেহাই পায়নি। আমাদের পায়ের নিচে থাকা টেকটোনিক প্লেটগুলো প্রতিনিয়ত নড়াচড়া করছে। এই নড়াচড়ার কারণে কিছু শিলা গুঁড়ো হয়ে যায়, আবার কিছু প্রচণ্ড চাপ ও তাপে হীরার মতো শক্ত বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। সম্প্রতি এমনই এক অতি প্রাচীন শিলার সন্ধান পাওয়া গেছে। কানাডার কুইবেক প্রদেশে খুঁজে পাওয়া এই শিলাটিকে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো শিলা বলে মনে করছেন। গবেষকদের মতে, এই শিলাগুলোর বয়স প্রায় ৪১৬ কোটি বছর। এই শিলা তৈরি হয়েছিল হেডিয়ান যুগে। অসাধারণ এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্স জার্নালে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলার সন্ধান মিলেছে কানাডায়

আরও পড়ুন

২. প্রথম এক্সোপ্ল্যানেটের ছবি

সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ শনি গ্রহের আকারের এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরগ্রহের সরাসরি ছবি তুলেছে। টিডব্লিউএ ৭বি (TWA 7b) নামে এই গ্রহ পৃথিবী থেকে ১১০ আলোকবর্ষ দূরে। দীর্ঘ তিন বছর ধরে সৌরজগতের বাইরে পরিচিত গ্রহগুলো নিয়ে গবেষণার পর, এবার এই শক্তিশালী টেলিস্কোপটি প্রথমবারের মতো একটি নতুন গ্রহের সরাসরি ছবি তুলতে পেরেছে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটি আগের দেখা যেকোনো গ্রহের চেয়ে এটি হালকা। টিডব্লিউএ ৭বি গ্রহটি একটি গ্যাসদানব। এটি প্রায় শনি গ্রহের সমান। প্রায় ৬০ লাখ বছরেরও বেশি পুরোনো একটি নক্ষত্রকে এটি প্রদক্ষিণ করছে। গ্রহটি গঠনের সময় থেকে এখনো উত্তপ্ত অবস্থায় আছে এবং জ্বলছে। এর আনুমানিক ভর পৃথিবীর প্রায় ১০০ গুণ এবং বৃহস্পতির ভরের ০.৩ গুণ। আগে যে সব এক্সোপ্ল্যানেটের ছবি তোলা হয়েছে, সেগুলোর চেয়ে এটি দশ গুণ হালকা। এই আবিষ্কারের কথা গত ২৫ জুন নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: শনি গ্রহের আকারের প্রথম এক্সোপ্ল্যানেটের ছবি তুলেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

৩. কোষের ভেতর নতুন অঙ্গাণু

আমাদের দেহের কোষের ভেতর এক নতুন অঙ্গাণু খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের বিজ্ঞানীরা এই নতুন অঙ্গাণুর নাম দিয়েছেন ‘হেমিফাসোম’ (Hemifusome)। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ছোট্ট অঙ্গাণুটি কোষের ভেতরে দরকারি জিনিসপত্র সংরক্ষণ করতে, অপ্রয়োজনীয় জিনিস পুনর্ব্যবহার করতে এবং পরিচ্ছন্নতায় ভূমিকা রাখে। এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন, জিনগত সমস্যা হলে কেন কোষের কাজগুলো ঠিকভাবে হয় না। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সেহাম ইব্রাহিম বলেন, ‘এটা অনেকটা কোষের ভেতরে একটি নতুন রিসাইক্লিং সেন্টার খুঁজে পাওয়ার মতো।’

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: কোষের ভেতর নতুন অঙ্গাণুর সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা

আরও পড়ুন

৪. মহাকাশে প্যাঁচার মুখ

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রতিদিন মহাকাশের নতুন নতুন রহস্য আমাদের সামনে তুলে ধরছে। এবার এই টেলিস্কোপ আমাদের থেকে প্রায় ১১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে ঘটে যাওয়া দুটি গ্যালাক্সির সংঘর্ষের ছবি তুলেছে। এই সংঘর্ষের ছবিটি দেখতে ঠিক যেন একটি প্যাঁচার মুখের মতো। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘কসমিক আউল’ বা ‘মহাকাশীয় প্যাঁচা’। যে দুটি গ্যালাক্সি এই সংঘর্ষে জড়িয়েছিল, সেগুলো এক বিশেষ ধরনের গ্যালাক্সি। এ ধরনের গ্যালাক্সিকে বলা হয় ‘রিং গ্যালাক্সি’। এমন রিং আকৃতির গ্যালাক্সি খুব কমই দেখা যায়। সাধারণত গ্যালাক্সিগুলো মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতো সর্পিলাকার বা লম্বাটে হয়। আমাদের জানা গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে এই দুর্লভ রিং গ্যালাক্সি মাত্র ০.০১ শতাংশ। নতুন এই গ্যালাক্সি দুটি আবিষ্কার করেছেন চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মিংইয়ু লি এবং তাঁর সহকর্মীরা। তাঁদের এই আবিষ্কার ছিল সম্পূর্ণ আকস্মিক। কসমস ফিল্ড নামে পরিচিত একটি অঞ্চলে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের ডেটা পর্যালোচনা করছিলেন তাঁরা। হঠাৎ এই অদ্ভুত প্যাঁচার মতো কাঠামো তাঁদের নজরে পড়ে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: জেমস ওয়েবে ধরা পড়ল দুই গ্যালাক্সির সংঘর্ষ, মহাকাশে প্যাঁচার মুখ!

৫. আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক পেল এআই

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৬তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড। এটি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য গণিতের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা। এই বছর এই প্রতিযোগিতায় গুগলের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জেমিনিও অংশ নিয়েছিল। জেমিনির পারফরম্যান্স ছিল এককথায় অসাধারণ। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে মোট ছয়টি সমস্যার সমাধান করতে হয়। জেমিনি এর মধ্যে পাঁচটি সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে এবং মোট ৪২ নম্বরের মধ্যে পেয়েছে ৩৫ নম্বর। এই ৩৫ নম্বরই ছিল এ বছর স্বর্ণপদক জেতার জন্য যথেষ্ট। মানব ইতিহাসে এই প্রথম কোনো যন্ত্র এই প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক অর্জন করল।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক পেল এআই

আরও পড়ুন

৬. বয়স বাড়া ঠেকাতে পারে ‘ম্যাজিক মাশরুম’

সম্প্রতি একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এক বিশেষ ধরনের ছত্রাকের মধ্যে চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘ম্যাজিক মাশরুম’। তাঁরা বলছেন, ম্যাজিক মাশরুমের প্রধান উপাদান ‘সিলোসাইবিন’ মানুষের কোষের আয়ু বাড়াতে পারে। বয়স্ক ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই গবেষণাটি গত ৮ জুলাই যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত নেচার গ্রুপের ‘npj Aging’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেইলার কলেজ অব মেডিসিনের গবেষক লুইস হেকার এবং তাঁর দল এই গবেষণাটি করেছেন। তাঁরা গবেষণাগারে মানুষের ফুসফুস ও ত্বকের কোষে সিলোসাইবিন ব্যবহার করে দেখেছেন, এর প্রভাবে কোষগুলোর আয়ু প্রায় ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। কোষগুলো যেন বয়সের ছাপ মুছে ফেলে আবার সতেজ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব হলো? এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: বয়স বাড়া ঠেকাতে পারে 'ম্যাজিক মাশরুম', নতুন গবেষণা

৭. নতুন ধরনের ব্ল্যাকহোল

বিজ্ঞানীরা মহাকাশে নতুন এক ধরনের ব্ল্যাকহোল খুঁজে পেয়েছেন। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘লাইট ব্ল্যাকহোল’। এই ব্ল্যাকহোলগুলো খুবই রহস্যময়। কারণ বিজ্ঞানীরা এতদিন এই আকারের ব্ল্যাকহোলের কথা জানতেন না। আগে বিজ্ঞানীরা মূলত দুই ধরনের ব্ল্যাকহোল চিনতেন। সম্প্রতি এই মাঝারি বা তুলনামূলক হালকা ধরনের ব্ল্যাকহোলের সন্ধান মিলেছে। এই নতুন ব্ল্যাকহোলগুলোর ভর সূর্যের চেয়ে ১০০-৩০০ গুণ বেশি। তবে এরা মৃত নক্ষত্র থেকে তৈরি হয়নি। আবার এদের কোনো পুরো গ্যালাক্সিকে ধরে রাখার মতো শক্তিও নেই।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে দেখুন: নতুন এক ধরনের ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, নিউইয়র্ক টাইমস ও বিবিসি, সায়েন্স এলার্ট, বিবিসি সায়েন্স, নিউ সায়েন্টিস্ট, পপুলার সায়েন্স, দ্য গার্ডিয়ান, স্পেস ডটকম, টেকসাইডেইলি ডটকম, রয়টার্স ও বিজ্ঞানচিন্তা।

আরও পড়ুন