রিকারশন ট্র্যাজেডি
‘You have decided being scared is caused mostly by thinking.’
—David Foster Wallace
পুনরাবৃত্তির চেয়ে ভয়াবহ কিছু আর নেই। আমি এখান থেকে, এই জীবন থেকে মুক্তি পেয়েই যাচ্ছিলাম প্রায়, শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়নি। এবং…এবং প্রতিবারই আমি এখান থেকে, এই জীবন থেকে মুক্তি পেয়েই যাই প্রায়, কিন্তু কোনোবারই শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয় না। প্রথমবার আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আত্মহত্যা করব…তখন, ঠিক ওই মুহূর্তে আমার রুগার এলসি-নাইন মডেলের পিস্তলটা মাথায় ঠেকালাম আর ট্রিগার চাপলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম মারা গেছি আমি, জীবনের সীমারেখা পার হয়ে এসেছি—কিন্তু না, আবার শুরু হলো সবকিছু শুরু থেকে। প্রতিবারই তা–ই হয়েছে, ঠিক ওই মুহূর্তে রুগার-এলসি নাইনের ট্রিগার টানামাত্রই আবার শুরু হয়েছে সবকিছু।
প্রথম প্রথম ভাবতাম শেষ, এবারই শেষ! এখন প্রতিবার ট্রিগার চাপার আগে আমি জানি কিছুই হবে না, আমি মুক্তি পাব না, আমি আত্মহত্যা করতে পারব না, আবার এসে হাজির হব এখানে। এই মুহূর্তে জানালাবিহীন ১২ ফুট বাই ১০ ফুট এই ঘরে আর ওই লোহার টেবিলের ড্রয়ার থেকে রুগার–এলসি নাইন বের করে মাথায় ঠেকাব। আর ট্রিগার চাপার আগে আমি ঠিক জানব এতে কিছুই হবে না…এই পুনরাবৃত্তির কততম চক্র, সাত শ নাকি আট শ নাকি হাজারতম চক্র চলছে, সেটা আমি জানি না। তবে যেহেতু এখন আমি জানি, আমার এই আত্মহত্যার চেষ্টা সফল হবে না আর আমি ঠিক ২১ দিন পরে…আবার ঠিক একুশ দিন পরে হাজির হব এখানে। এই মুহূর্তে, এই ঘরে, তাই আমি আর আত্মহত্যা করতে চাই না বা কিছুই করতে চাই না, কিন্তু সব ঘটনা তারা নিজেদেরকে নিজেরা পুনরাবৃত্তি করতে করতে আমাকে নিয়ে আসে এখানে।
আমি জেনোবিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম সেদিন ভোরবেলায়, এপ্রিলের ২৮ তারিখ, ভোরের আলো তখন কেবল ফুটতে শুরু করেছে। যখন জেনোবিয়ার সেন্ট্রাল জেলগেটে পৌঁছালাম, তখন বেলা একটা বাজে। আরও আগেই পৌঁছানোর কথা ছিল, কিন্তু পথে চারটা চেকপোস্টে থামতে হয়েছে। প্রতিটি পোস্টে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আধা ঘণ্টা করে ধরলেও অন্তত দুই ঘণ্টা সময় বেশি লেগেছে। গত ডিসেম্বরের সরকার বদল, মানে মিলিটারি ক্যু, এর পর থেকেই এই অবস্থা।
সবাই জানত কিছু একটা হবে, কিছু একটা হবে। তবে কোনোরকম পূর্বাভাস না দিয়েই, কোনো ঝামেলা ছাড়াই গত ডিসেম্বরের ৯ তারিখ রাত ১২টার পরে কোনো এক সময়ে যখন অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে আর যাদের রাতে দেরিতে খাওয়ার অভ্যাস, তারা তখনো ডাইনিং টেবিলে, সামায়েল গভর্নমেন্টকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে একটা সফল মিলিটারি ক্যু হলো। তার পরের দিনই অ্যাডেলমা থেকে জোরা পর্যন্ত প্রতিটা শহরের প্রতিটা রাস্তায় মিলিটারি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। আর হাইওয়েতে তিন মাইল পরে পরে একটা করে চেকপোস্ট।
প্রতিটি পোস্টে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আধা ঘণ্টা করে ধরলেও অন্তত দুই ঘণ্টা সময় বেশি লেগেছে। গত ডিসেম্বরের সরকার বদল, মানে মিলিটারি ক্যু, এর পর থেকেই এই অবস্থা।
আমি আর জেলখানার মূল গেট পর্যন্ত যেতে পারলাম না। মানে যাওয়ার উপায় নেই কোনোভাবেই। কয়েক গজ পরে পরে উঁচু করে স্পাইক স্ট্রিপ বসানো হয়েছে। যেখানে দাঁড়ালাম, লেকের ওপরে ছোট চওড়া একটা কালভার্ট, নিচে পানির স্রোত বেশ ভালোই। সেখান থেকে ওই মূল গেটের দূরত্ব কম করে হলেও আধা মাইল। এই আধা মাইলের মধ্যে তিনটা পয়েন্টে তিনজন করে গার্ড দাঁড়ানো। প্রত্যেকের হাতে বেনেলি এম-১৩ সেমি অটোমেটিক ট্যাকটিক্যাল শটগান। বুঝলাম, হেঁটেও কাউকে এর থেকে বেশি এগোতে দেওয়া হবে না। একটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ভেতরের আনুষ্ঠানিকতা ১২টার মধ্যেই শেষ করে এতক্ষণে ওর বের হয়ে আসার কথা। সিগারেট অর্ধেক শেষ হয়েছে, দেখলাম, জেলখানার মূল গেট বেশ জোরে শব্দ করতে করতে দুই দিকে সরে গেল।
কয়েক সেকেন্ড পর কেউ একজন বের হয়ে আসছে খুব ধীরস্থিরভাবে, তার হাঁটার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া বা অস্থিরতা নেই। নিশ্চিত হতে পারলাম না প্রথমে এত দূর থেকে, কালো ওভারকোট পরা ব্যাগ হাতে কৃশকায় শান্ত বের হয়ে আসা ওই লোকই জর্ডিন কি না।
কয়েক মিনিট পরে কিছু দূর এগিয়ে এলেই বুঝতে পারলাম, হ্যাঁ, সে-ই, জর্ডিন। আমার পিতা বা ভাইয়ের চেয়েও আমার বেশি কাছের, বেশি নির্ভরতার, আমার জীবনের সবচেয়ে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মানুষ জর্ডিন। নিশ্চিত হওয়ামাত্রই ভেতরে–ভেতরে আমার উত্তেজনা বেড়ে গেল আর হার্টবিটও বাড়তে থাকল। দুই মাস, মাত্র দুই মাসের জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
জর্ডিনের মাথার অর্ধেকের বেশি চুল সাদা হয়ে গেছে। আমি বললাম, দুই মাস, মাত্র দুই মাস!
আমি আশা করিনি, সে সামান্য হেসে উত্তর দিল, দুই মাস অনেক সময়। অনেক!
চেকপোস্ট এড়ানোর জন্য হাইওয়ে ছেড়ে বনের ভেতরের একটা রাস্তা দিয়ে জর্ডিনকে আমি পরিত্যক্ত ব্ল্যাক-আই বেজের পেছনের বাড়িটাতে নিয়ে এলাম। সেখানে একসময় আমাদের নিয়মিত দেখা হতো। আমি সরাসরি জর্ডিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই দুই মাসে কী পরিকল্পনা তোমার? কী করবে?
সে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কাছে দিয়ে না গিয়ে, আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রশ্ন করল, স্টিলগারের সঙ্গে দেখা হয় তোমার? যোগাযোগ আছে?
আমি মাথা নেড়ে না করলাম। বললাম, কয়েক বছর আগে আমাকে ডেকেছিল স্টিলগার, আমি গিয়েছিলাম। সে–ই শেষ।
শুনে একবার ভ্রু নাচাল জর্ডিন। জিজ্ঞাসা করল, ডেকেছিল কেন?
বললাম, সে হকিং রেডিয়েশন…মানে ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্সের একটা সমাধান বের করেছে, হাইপোথেটিক্যাল। এন্ট্রপির ইকুয়েশন। সেটা প্র্যাকটিক্যালি পরীক্ষা করে দেখতে চায়। আমাকে কাজে লাগাতে চায়।
তাকে একটু আগ্রহী মনে হলো, জিজ্ঞাসা করল, ল্যাবে?
আমি ইতস্তত করে অবশেষে বললাম, প্রথমে থট এক্সপেরিমেন্ট এবং ল্যাবে খুব দ্রুত…তারপরে, রিয়াল সিনারিওতে…
হাসল জর্ডিন, মনে হলো তাচ্ছিল্য করতে চাইল। বলল, তার মানে গারগানচুয়া?
এই আলোচনা আমার ভালো লাগছিল না। স্টিলগার যদি সত্যি সত্যি ইনফরমেশন প্যারাডক্স নিয়ে কিছু করতে পারে, তাহলে আমি জানি জর্ডিনের চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না এবং স্টিলগারও সবার প্রথমে প্রকাশ্যে ঋণ স্বীকার করবে জর্ডিনের প্রতি। তা–ও জর্ডিন এমন ভাব করতে চায় যেন স্টিলগারকে সে অবহেলা করে ভীষণ।
আমি উত্তর দিলাম, সম্ভবত। গারগানচুয়া যে রেডিয়েশন বিকিরণ করছে, সেখান থেকে নাকি স্টিলগারের ওই ইকুয়েশনের মাধ্যমে ইনফরমেশন আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, যদি…
স্টিলগার যদি সত্যি সত্যি ইনফরমেশন প্যারাডক্স নিয়ে কিছু করতে পারে, তাহলে আমি জানি জর্ডিনের চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না এবং স্টিলগারও সবার প্রথমে প্রকাশ্যে ঋণ স্বীকার করবে জর্ডিনের প্রতি।
আমাকে বাধা দিল সে, কী রেডিয়েশন বিকিরণ করছে? সেটার তো একটা পার্টিকুলার নাম আছে, তাই না? তুমি তার ব্যাপারে অবলিভিয়াস কেন, কেন তার নাম উল্লেখ করতে ভুলে যাও; তাকে পছন্দ করো না, এই কারণে? তাকে তোমার অনেক বেশি হাইপোথেটিক্যাল মনে হয়, এই কারণে? এটা বেয়াদবি…স্টুপিড অ্যারোগেন্স। ইউনিভার্সের মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন নিয়ে তোমার স্টেটমেন্ট কিন্তু এখনো এস্টাবলিশড নয়…
এতগুলো কথা জর্ডিন আমাকে বলল কোনো উত্তেজনা ছাড়াই, কণ্ঠের কোনোরকম ওঠানামা ছাড়াই, খুবই শান্তভাবে। বলা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসল সে।
আমি বললাম, সরি, হকিং রেডিয়েশন।
প্রসঙ্গ বদলে সে হঠাৎ বলে উঠল, স্টিলগার বলে, আমি নাকি বেইমান, বিশ্বাসঘাতক। আমার এক সাবেক ছাত্র পারমিশন ম্যানেজ করে জেলখানায় দেখা করতে গিয়েছিল আমার সঙ্গে, সে জানিয়েছে।
সে আবার জিজ্ঞাসা করল, তা তুমি তার প্রস্তাবে রাজি হওনি?
বললাম, সে জানায়নি পরে আর কিছু, যোগাযোগ করেনি আর।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে, আমাকে বিস্ময়ের খাদের কিনারে নিয়ে গিয়ে, হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে একেবারে নিচে ফেলে দিল জর্ডিন। বলল, পরশু দিন বিকেলে আমি স্টিলগারের সঙ্গে দেখা করতে যাব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।…আমার প্যারোলে মুক্তির ব্যবস্থা সে-ই করিয়েছে।
পরদিন সকাল আটটার দিকে ফোন করে জর্ডিন আমাকে তার ওখানে যেতে বলল। আধা ঘণ্টার মধ্যে। পরিত্যক্ত ব্ল্যাক-আই বেজের পেছনের সেই বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম, দুটি মিলিটারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল তারা। জর্ডিন ছাড়াও ইউনিফর্ম পরা দুজন অফিসার আছে সেখানে। অফিসার দুজন দাঁড়ানো, জর্ডিন ডিভানে বসা। আমাকে দেখামাত্রই বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল সে, অফিসার দুজনকে এবং আমাকে একসঙ্গে বাইরের দিকে যাওয়ার ইশারা করল।
জিপের পেছনে ওঠামাত্রই একজন অফিসার এসে কালো কাপড় দিয়ে আমাদের দুজনেরই চোখ বেঁধে দিল। আমি টের পেলাম, গাড়ি স্টার্ট দেওয়া হলো। এরপর কতক্ষণ বা কয় ঘণ্টা গাড়ি চলেছে, সেটা আমি আন্দাজ করতে পারিনি। সম্ভবত জর্ডিনও পারেনি। এরপর গাড়ি থামল, চোখ বেঁধেই আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে একটা হেলিকপ্টারে ওঠানো হলো। হেলিকপ্টার পর্ব শেষ হলে একটা জায়গায় নিয়ে আমাদের চোখের ওপর থেকে কালো কাপড় সরানো হলে দেখলাম, আমাদের একটা সাউন্ডপ্রুফ ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। ঘরের একটা দিকের দেয়াল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, কাচের। তার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি, ঢেউ আর ঢেউ, দিগন্ত আর সমুদ্র মিশে একাকার হয়ে গেছে। সম্ভবত, না, নিশ্চিতই বলা যায়, আমরা সমুদ্রের মাঝখানে আছি, কোনো যুদ্ধজাহাজে অথবা কোনো পার্মানেন্ট মিলিটারি বেজে।
পাঁচ-সাত মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরে মাঝবয়সী ইউনিফর্ম পরা একজন অফিসার এসে ঘরে ঢুকল। আমার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরাল জর্ডিনের দিকে। আমার জন্য অপরিচিত হলেও জর্ডিনকে দেখে মনে হলো, সে আগে থেকেই চেনে তাকে, তার পরিচয় জানে। ওই লোক, মিলিটারি অফিসার। সে নিজের পরিচয় দিল আর আমি অবিশ্বাসে চেয়ার থেকে ছিটকে পড়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। সে বলল, আমি এলিয়াম।
পরদিন সকাল আটটার দিকে ফোন করে জর্ডিন আমাকে তার ওখানে যেতে বলল। আধা ঘণ্টার মধ্যে। পরিত্যক্ত ব্ল্যাক-আই বেজের পেছনের সেই বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম, দুটি মিলিটারি জিপ দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বিশ্বাস হতে চাইছিল না যে আমার সামনে দাঁড়ানো এই ব্যক্তি এলিয়াম। ক্যারিশম্যাটিক এক তরুণ অফিসার এলিয়াম, যে তার সিনিয়রদের অগ্রাহ্য করে, সব চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে ‘শান্তিতে’ এবং একেবারে নীরবে একটা সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। এরপর, দীর্ঘ কয়েক বছর পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া সব স্পেস রিসার্চ ল্যাব ও প্রজেক্ট আবার খুলে দিয়েছে ও চালু করেছে। ক্ষমতাবান কারও শরীর থেকে সব সময় অদৃশ্য এক স্পেকট্রাম বিকিরণ হতে থাকে। সেটা কেউ চাইলেও না দেখে থাকতে পারে না, এলিয়ামের থেকেও সেই একই স্পেকট্রাম বিকিরিত হচ্ছিল।
সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল জর্ডিনের দিকে এবং সম্ভবত বুঝতে পারল যে এখানে ভূমিকা করার কিছু নেই। জর্ডিনের দিকে তাকিয়ে, চোখের পাতা না ফেলে বলল, একটা অনুরোধ করার জন্য আপনাদের এখানে আনা হয়েছে। আমাদের সাহায্য করবেন আপনারা।
জর্ডিন জিজ্ঞেস করল, কী সেটা?
এলিয়াম উত্তর দিল, আমাদের আসলে সরাসরি স্টিলগারের সাহায্য দরকার। তাকে দরকার। আমাদের জন্য একটা সমস্যার সমাধান করতে হবে তাকে, ফর দ্য সেইক অব ম্যানকাইন্ড…ফর দ্য সেইক অব দিস ইউনিভার্স। আপনারা সাহায্য করবেন তাকে, কনভিন্স করবেন।
নড়েচড়ে বসল জর্ডিন। বলল, সে কি সাহায্য করতে অস্বীকার করেছে?
এলিয়াম উত্তর দিল, না, স্পষ্ট করে সে কিছু বলেনি। কোনো কমিটমেন্ট দেয়নি সে। শুধু জানিয়েছিল, আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে। আমরা বলেছিলাম, না, সেটা সম্ভব হবে না। কারণ, জর্ডিন, আপনি কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের সফল সিমুলেশন করার পরও লার্জার স্কেলে সেটা বাস্তবায়ন করতে রাজি হননি। উপরন্তু সিমুলেশনের সব প্রমাণ ও ডেটা ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। এটা শুধু নিজের দেশের সঙ্গে বেইমানি নয়, নিজের জাতির সঙ্গে নয়, পুরো মানবজাতির সঙ্গে বেইমানি। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, যত কিছুই হয়ে যাক, আপনাকে ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা বলেছিলাম স্টিলগারকে, আমরা চাইলেও পারব না। তখন দুই মাসের প্যারোলে রফা হয় আরকি!
জর্ডিন মনে হলো খুব মজা পেয়েছে। কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসছে।
এলিয়াম আবার বলতে থাকল, কিন্তু আমরা বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। আমরা চাই, আপনার এই প্যারোল দুই মাস নয়, চিরস্থায়ী হোক, আপনি প্রফেসরশিপ ফেরত পান। ইউনিভার্সিটি অব হাইপেশিয়ার কোয়ান্টাম অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস—এই দুটো বিভাগের দায়িত্ব আপনার হাতে থাকুক।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের সমস্যা কী আসলে? স্টিলগারের কাছে কী চাইছেন আপনারা?
এলিয়াম একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার জর্ডিনের দিকে তাকাল। বলল, সেটা আপনারা তার কাছে থেকেই আরও ভালো করে শুনতে পারবেন। আমার চেয়ে তার বলাটা আপনাদের জন্য কাজের হবে বেশি। আগামীকাল তো যাচ্ছেন তার সঙ্গে দেখা করতে? সে ডেকেছে আপনাদের?
জর্ডিন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
এলিয়াম বলল, বেস্ট অব লাক। বলেই সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল ওখান থেকে।
আমাদের যেভাবে নিয়ে আসা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই আবার রেখে আসা হলো। চোখ বেঁধে হেলিকপ্টারে করে, আর তারপরে বাকি পথ আবার জিপে।
পরের দিন স্টিলগারের কাছে যাওয়ার সময় জর্ডিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে আমার কাজ কী, আমার ইনভলভমেন্ট কী? আমি বুঝতে পারছি না। তোমার সঙ্গী হিসেবে ভূমিকা পালন করা হলে ঠিক আছে। কিন্তু এর বাইরে কি কিছু আছে আমার জন্য? আমি বুঝতে পারছি না।
সে উত্তর দিল, অবশ্যই আছে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে।…স্টিলগার তোমাকে কয়েক বছর আগে ডেকে নিয়েছিল না, ব্ল্যাকহোলের হকিং রেডিয়েশন-ইনফরমেশন প্যারাডক্সের প্র্যাকটিক্যাল সমাধান বের করেছে জানিয়েছিল, এখানে পুরো ব্যাপারটা সেটা নিয়েই।
স্টিলগারের ওখানে পৌঁছে বুঝতে পারলাম, সে আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। জর্ডিনকে দেখে সে দুহাত বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘আমি কি ঠিক দেখছি?’
জর্ডিন হেসে জবাব দিল, ‘আমি শিওর নই।’ তবে এ ব্যাপারে শিওর যে আমি সেই একই স্টিলগারকে দেখছি।
ধূসর রঙের একটা সোয়েটার পরে আছে স্টিলগার, তার কামানো মাথা চকচক করছে, চশমার ভেতর দিয়েও তার উজ্জ্বল চোখের তীক্ষ্ণতা টের পাওয়া যাচ্ছে। কত হবে, আটান্ন বয়স স্টিলগারের, তবে দেখে বোঝার উপায় নেই।
স্টিলগারের সঙ্গে আলোচনায় বসে জর্ডিন প্রথমেই একটা খোঁচা মারল তাকে, ডিসেম্বরের মিলিটারি ক্যুর পেছনেও কি তোমার হাত আছে?
ভেবেছিলাম এর জবাবে স্টিলগার আরও তীক্ষ্ণ খোঁচা মারবে। সে খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল, না।
আরও কিছু সাধারণ কথাবার্তা ও খাওয়াদাওয়ার পর আমরা স্টিলগারের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। আমরা জানতে চাইলাম এলিয়ামের ব্যাপারটা, সে আসলে কী সমাধান করার জন্য তার সাহায্য চায়। কী সেই সমস্যা, যার জন্য সে বলেছিল, ‘ফর দ্য সেইক অব ম্যানকাইন্ড!’
স্টিলগার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই বলতে শুরু করল, গারগানচুয়ার ওখানে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে। ইভেন্ট হরাইজন পার হয়ে যে আলো, মানে যেসব ফোটন গারগানচুয়ার ভেতরে ঢুকছে ইমিডিয়েটলি…ইমিডিয়েটলি সেই আলোর, সেই সব ফোটন তার অ্যান্টিপার্টিকেল হয়ে ফেরত আসছে।
জিনিসটা অস্বাভাবিক হলেও তেমন কোনো গুরুতর সমস্যা মনে হয়নি তখন আমাদের কাছে। আমি বললাম, তার মানে আবার পার্টিকেল ফোটনই ফিরে আসছে, যেহেতু ফোটনের অ্যান্টিপার্টিকেল তো ফোটনই। হ্যাঁ, অস্বাভাবিক, এর কোনো ব্যাখ্যা আপাতত নেই।
ধূসর রঙের একটা সোয়েটার পরে আছে স্টিলগার, তার কামানো মাথা চকচক করছে, চশমার ভেতর দিয়েও তার উজ্জ্বল চোখের তীক্ষ্ণতা টের পাওয়া যাচ্ছে।
স্টিলগার বলল, না, ফোটনের অ্যান্টিপার্টিকেল একই ফোটন ফিরে আসছে না। যা ফিরে আসছে, সেই ধরনের ফোটন, সেই পার্টিকেল এই ইউনিভার্সের নয়। অনেকটা একই রকম, কিন্তু একই নয়। সেই ফোটন পার্টিকেলের অস্তিত্ব আমাদের ইউনিভার্সে নেই। আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে, সেই অ্যান্টিপার্টিকেল ফোটনগুলো স্বাভাবিক ফোটনগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। স্বাভাবিক ফোটনগুলো ওই নতুন ধরনের অ্যান্টিপার্টিকেল ফোটনের সংস্পর্শে আসামাত্রই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।
সত্যি সত্যি ভয় পাওয়ার মতো ব্যাপার, আতঙ্কিত হওয়ার মতো ব্যাপার। আমার উত্তেজনা বেড়ে গেল।
স্টিলগার বলল, শুধু এখানেই শেষ হলে কথা ছিল, এই সমস্যা আরও ভয়ানক দিকে যাচ্ছে, ধংসাত্মক দিকে যাচ্ছে আরেকটা কারণে।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই জর্ডিন বলল, বুঝতে পেরেছি, ইভেন্ট হরাইজনের রেডিয়াস আরও বড় হয়ে যাচ্ছে।
জর্ডিনের দিকে সামান্য মুগ্ধতার চোখে তাকাল স্টিলগার। আমি আবারও বুঝতে পারলাম, কেন স্টিলগার জর্ডিনকে এত পছন্দ করে।
স্টিলগার বলল, হ্যাঁ। অনেক ব্ল্যাকহোলে, যেমন মেসিয়ার সেভেনটি সেভেন, সেনটরাস—এসব জায়গায় ইভেন্ট হরাইজন বলে কিছু আর নেই। গ্র্যাভিটি টাচড ইনফিনিটি। আলো, মানে সব ফোটন প্রবল গ্র্যাভিটির টানে ঢুকছে এবং একধরনের প্রায় অলৌকিক ফোটন অ্যান্টিপার্টিকেল বের হয়ে এসে আলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ইউনিভার্সের সব ফোটন, সব আলো নিঃশেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ফাইনাল রেজাল্ট হলো, আলো বলে কিছু আর থাকবে না ইউনিভার্সে।
জর্ডিন অধৈর্য হয়ে উঠল, বলল, তার মানে এই ইউনিভার্সও থাকবে না।
স্টিলগার একটু শুষ্ক হাসি হাসল, বলল, হ্যাঁ, কারেক্ট।
জর্ডিন বলল, এই অবস্থায় হাসতে পারছ তুমি!
স্টিলগারের হাসি মনে হয় আরেকটু বিস্তৃত হলো। সে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বলল, জৈনধর্ম কীভাবে শুরু হয়েছিল, জানো সেই কাহিনি? গৌতম বুদ্ধের একজন শিষ্য ছিল, নাম মহাকশ্যপ। বুদ্ধের অন্য শিষ্যরা তাকে বোকা মনে করত, পাগল মনে করত; কারণ, বুদ্ধ তার ছাত্রদের উদ্দেশে যে লেকচার দিত, সেটা সে শুনত না, সেটার প্রতি কোনোরকম আগ্রহ দেখাত না। সে একটা গাছের নিচে বসে থাকত। অন্যদের মতো বুদ্ধিমান সে ছিল না, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান নিয়ে তার মধ্যে তীব্র আগ্রহ ছিল না, সে শুধু বসে থাকত। সবাই তার আশা ছেড়ে দিয়েছিল, মনে করত যে তার মতো বোকা একজনকে কিছু শেখানো যাবে না। একদিন গৌতম একটা ফুল হাতে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন, তিনি অনেকক্ষণ ধরে সেই ফুলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
ছাত্ররা সবাই অপেক্ষা করছিল যে তিনি কথা শুরু করবেন, কিন্তু বুদ্ধ কিছু না বলে সেই ফুলের দিকে তাকিয়েই ছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল, তখনো গৌতম তাকিয়েই আছেন তার হাতের সেই ফুলের দিকে। হঠাৎ সেই মহাকশ্যপ খুব জোরে শব্দ করে হেসে উঠল। গৌতম তখন সমবেত সবার উদ্দেশে বললেন, যা আমি ভাষায় দিতে পারি, তা আমি তোমাদের দিয়েছি আর যা ভাষায় দিতে পারি না, তা আমি মহাকশ্যপকে দিয়েছি। শুরুটা এভাবেই ছিল, জৈনধর্মের। তুমি বসে বসে অপেক্ষা করো; যখন যেটা হওয়ার, সেটা হবে।
বুঝতে পারলাম, প্রচণ্ড বিরক্ত হলো জর্ডিন। সে বলল, ইউনিভার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে আর তুমি…তুমি জৈন প্র্যাকটিস করছ!
স্টিলগার বলল, প্র্যাকটিস করছি না। জাস্ট একটা গল্প শেয়ার করলাম। ইউনিভার্স শেষ হয়ে যাচ্ছে…ইউনিভার্স যেহেতু হঠাৎ শুরু হয়েছে, শেষটাও হঠাৎই হওয়ার কথা এবং এ ব্যাপারে ইউনিভার্স খুব ইনডিফারেন্ট, আমাদের প্রতিও ইউনিভার্স ইনডিফারেন্ট। এখন, আমরা, মানে পুরো মানবজাতি টিকে থাকি বা ধ্বংস হয়ে যাই, তাতে ইউনিভার্সের কিছু আসে–যায় না, সে তার নিজের মতো ফাংশন করতে থাকবে। ইউনিভার্স তার নিজের ব্যাপারেও ইনডিফারেন্ট, টিকে থাকল নাকি শেষ হয়ে গেল, কিছুতেই কিছু আসে–যায় না। যা হওয়ার, তা হবে। এটা ইউনিভার্সের ভেরি বেসিক থিং।
আমি বুঝতে পারলাম, জর্ডিন কেন এত অপছন্দ করে স্টিলগারকে। যে ব্যক্তি দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়ে কোনো চলমান সংকট বা প্রসঙ্গের গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে, তাকে জর্ডিনের মতো সিরিয়াস মানুষের পক্ষে পছন্দ করাটা কঠিন।
এরপর আমরা সরাসরি সেই আলাপে গেলাম, সেই যে স্টিলগার আমাকে ডেকেছিল কয়েক বছর আগে, ব্ল্যাকহোলের ইনফরমেশন প্যারাডক্সের সমাধানের কথা বলতে।
জর্ডিন জিজ্ঞেস করল, তুমি অনেক আগেই, তখনই এ রকম কিছু যে হবে, সেটা আন্দাজ করেছিলে?
স্টিলগারের হাসি মনে হয় আরেকটু বিস্তৃত হলো। সে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বলল, জৈনধর্ম কীভাবে শুরু হয়েছিল, জানো সেই কাহিনি?
স্টিলগার এর কোনো উত্তর দিল না। বরং সে যেটা জানাল, এনট্রপিকে আমরা দেখি কোনো সিস্টেমের ডিজঅর্ডারের পরিমাপ করার জন্য। এনট্রপিকে দেখতে হবে কোনো সিস্টেমের ডিজঅর্ডারের কারণে যে পরিমাণ ইনফরমেশন হারিয়ে যাচ্ছে, সেটার পরিমাপ হিসেবে। তাহলেই, সেই সিস্টেমের কোনো পার্টিকলের কোয়ান্টাম মাইক্রোস্টেট—স্পিন, এনট্যাঙ্গলমেন্ট অবস্থা, অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম—এই সব জানা সম্ভব হবে।
এরপর স্টিলগার আমাদের তার লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল। সে তার নতুন এনট্রপির সমীকরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিল, হকিং রেডিয়েশনে ব্ল্যাকহোল জোড়ায় জোড়ায় যে ভার্চ্যুয়াল পার্টিকেল বিকিরণ করে, একটা বাইরের দিকে চলে আসে আর আরেকটা থেকে যায় ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরেই। ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরেই, সেই পার্টিকলের কোয়ান্টাম স্টেট নির্ধারণ করা সম্ভব। এবং দেখা যাচ্ছে যে সেই পার্টিকলের আচরণ হায়ার ডাইমেনশনের কোনো ইউনিভার্সের পার্টিকেলের মতো, ভেতরের সেই ভার্চ্যুয়াল পার্টিকেলকে নিয়ন্ত্রণ করছে হায়ার ডাইমেনশনের কেউ, অন্য ইউনিভার্সের কোনো শক্তি। এবং তার কারণেই, অন্য কোনো বেশি মাত্রার ইউনিভার্স থেকে হয়তো ফোটন অ্যান্টিপার্টিকেল আসতে পারছে।
স্টিলগার বলল, এবং সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ও ভয়ংকর কথা কী জানো?
জর্ডিন মাথা নাড়ল, বলল, ভেতরের সেই ভার্চ্যুয়াল পার্টিকেল স্পেসটাইমের সঙ্গে ইন্টারেক্ট করে না।
স্টিলগার বলল, ঠিক তা–ই, সেই পার্টিকেলের জন্য স্পেসটাইম কিছু এক্সিস্ট করে না।
স্টিলগারের ওখান থেকে ফেরার সময় জর্ডিন বলল, আমি এখন বুঝতে পারছি, কেন ওরা আমাকেই বেছে নিল। ভেতরে যে ভার্চ্যুয়াল পার্টিকেল থাকছে, হায়ার ডাইমেনশনের, সেগুলোর সঙ্গে বাইরের সাধারণ পার্টিকেলের বিশেষ একটা এনট্যাঙ্গলমেন্ট তৈরি করতে হবে এবং সেই পার্টিকেলগুলোকে স্পেসটাইমের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করাতে হবে।
এই এনট্যাঙ্গলমেন্ট আমি ছাড়া কেউ ঘটাতে পারবে না। আর, পরে সেগুলোকে স্পেসটাইমের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করাতে হবে কোয়ান্টাম মাইক্রোওয়েভ দিয়ে। এখন বুঝতে পারছ, তোমার কাজটা কী? ফাইনাল পার্ট তোমার হাতে…যদি সেই পার্টিকেলগুলো স্পেসটাইমের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করা শুরু করে, তাহলে তারা আর হায়ার ডাইমেনশনের আচরণ করবে না। ভেতরের হায়ার ডাইমেনশন এনভায়রনমেন্ট আর টিকবে না, নষ্ট হয়ে যাবে। স্বাভাবিক হবে। ইউনিভার্সের বাইরের ফোটন অ্যান্টিপার্টিকেল আর আসবে না বা জেনারেট হবে না আশা করা যায়।
ভেতরে যে ভার্চ্যুয়াল পার্টিকেল থাকছে, হায়ার ডাইমেনশনের, সেগুলোর সঙ্গে বাইরের সাধারণ পার্টিকেলের বিশেষ একটা এনট্যাঙ্গলমেন্ট তৈরি করতে হবে।
আমার কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে, স্টিলগার কিন্তু আমাদের এখনো মাইক্রোস্টেট এনট্রপি সমীকরণ পুরোটা দেখায়নি। সে এটাকে সিঙ্গুলারিটির দিকে নিয়ে যেতে চায়…যা–ই হোক, যেকোনোভাবেই তাকে কনভিন্স করতে হবে।
জর্ডিন ফেরার পর আমি অনেকক্ষণ একা একা হাঁটলাম বাসায় ফেরার আগে। বাইরে ভালোই ভিড়, রাস্তায় মানুষজন আছে অনেক। ক্যুর পরে অনেক দিন একটা থমথমে ভাব ছিল, সবকিছু আর সবার মধ্যে, সেটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। বাসায় ঢোকার আগমুহূর্তে আমি জোহারিনকে ফোন করলাম। গত পরশু, মানে ২৮ তারিখ তার জন্মদিন ছিল এবং ফোন বন্ধ তার। আমি একটা ভয়েস মেসেজ পাঠাতে চেয়েও সেটা করলাম না আর।
এর পরের দুই সপ্তাহ খুব ব্যস্ততার মধ্যে গিয়েছিল। স্টিলগার মোটামুটি কনভিন্সড হয়েছিল। জর্ডিন গারগানচুয়ার ভেতরের হকিং রেডিয়েশনের সেই ভার্চ্যুয়াল পার্টিকেল, যা নিয়ন্ত্রিত হয় হায়ার ডাইমেনশনের কোনো ইউনিভার্স থেকে, তার সঙ্গে সাধারণ পার্টিকেলের এনট্যাঙ্গলমেন্ট তৈরি করল। মিলিটারি হেডকোয়ার্টার থেকে সবকিছু তদারক করা হচ্ছিল, এলিয়াম নিজেই সরাসরি যোগাযোগ করছিল আমাদের সঙ্গে। সংখ্যায় অনেক অফিসার ও সৈনিক আমাদের হয়ে খাটাখাটনি করছিল। ১৫ তারিখ রাতে আমি LIGO-7-এ স্টিলগারের সমীকরণ থেকে পাওয়া এনট্রপি টার্গেট করে কোয়ান্টাম মাইক্রোওয়েভ তৈরি করলাম। আমি, আমরা আশাবাদী ছিলাম যে সেগুলো ভালোভাবেই ইন্টার৵াক্ট করবে স্পেসটাইমের সঙ্গে। বুঝতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগার কথা।
সেদিন রাতেই কেন জানি না, আমাকে ফোন দিয়েছিল জোহারিন, দেখা করবে সে আমার সঙ্গে। আমি খুব খুশি হয়ে উত্তেজিত হয়ে পরদিন সকালে বের হলাম। যাওয়ার পথে দুটি সাংঘাতিক খবর এল আমার কাছে, আমি কোনো কিছুই মেলাতে পারলাম না। এক. জর্ডিনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সম্ভবত জেনোবিয়ার সেন্ট্রাল জেলে; দুই. স্টিলগারকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। স্থবির হয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম। জোহারিন আসবে আর ১০ মিনিট পরে। এর মধ্যেই একটা জিপ এসে থামল ক্যাফের কাচের দেয়ালের বাইরে। চারজন ইউনিফর্ম পরা অফিসার নেমে দ্রুত ভেতরে ঢুকে আমাকে বের করে নিয়ে গাড়িতে তুলল।
এর পরের ভয়াবহ সেই তিন দিনের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি না, জানি না আমি। আমি শুধু জানতে পারলাম, যে টার্গেট এনট্রপির জন্য আমরা কোয়ান্টাম ওয়েভ তৈরি করেছিলাম, তাতে গারগানচুয়ার ভেতরের সেই পার্টিকেলগুলো ইন্টার্যাক্ট করতে থাকে স্পেসটাইমের সঙ্গে। কিন্তু বিপর্যয়টা হলো, সেগুলো শুধু ভবিষ্যৎ একুশ দিনের স্পেসটাইমের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করে রিকারসিভভাবে, পুনরাবৃত্তিমূলকভাবে। এবং যেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে, স্টিলগারের সেই সমীকরণে পুনরাবৃত্তির একটা রিকারশন ভেরিয়েবল ছিল, যেটার মান অসীম।
তিন দিন পরে আমাকে আনা হলো এই ঘরে, ১২ ফুট বাই ১০ ফুট। সেখানে একটু পরই আমি ওই লোহার টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোট্ট রুগার–এলসি নাইন বের করে আত্মহত্যার জন্য নিজের মাথায় গুলি করব। আর বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে জেনোবিয়ার সেন্ট্রাল জেলের সামনের কালভার্টে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকব।