বিজ্ঞানচিন্তার চোখে মহাকাশের আলোচিত ১০

প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও ভালোভাবে গবেষণা করতে পারছে। মহাকাশ নিয়েও এ বছর হয়েছে প্রচুর গবেষণা। বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে সেসব আলোচিত গবেষণার খবর। পাশাপাশি বছর শেষে নানা ম্যাগাজিন ও ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে সারা বছরের আলোচিত বিভিন্ন গবেষণার তালিকা। সেখান থেকে আলোচিত এক ডজন গবেষণা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো এখানে।

সৌরজগতে নতুন আগন্তুক

ধূমকেতু 3I/ATLAS
ছবি: নাসা

বছরের দ্বিতীয়ার্ধের সেরা চমক ছিল Comet 3I/ATLAS নামে একটি ধূমকেতু। এটি আমাদের সৌরজগতের বাইরের কোনো এক অজানা নক্ষত্রমণ্ডল থেকে এসেছে। জুলাই মাসে চিলির এক মানমন্দির এটি আবিষ্কার করে। এর গতি ছিল সেকেন্ডে ৫৮ কিলোমিটার। সাধারণ ধূমকেতুর গতির চেয়ে এ গতি অনেক বেশি! বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি আমাদের সৌরজগত তৈরিরও আগে থেকে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর লেজের দিকে একটা উল্টো লেজ দেখা গেছে, যা সাধারণত দেখা যায় না। ২০২৬ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এর ওপর নজর রাখবেন।

এ ব্যাপারে বিস্তারিত পড়ুন এখানে: সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা ধূমকেতু নিয়ে বিজ্ঞানীরা এত উত্তেজিত কেন

ব্ল্যাকহোলের জন্মরহস্য

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে তোলা কিছু ছোট লাল বিন্দুর ছবি
ছবি: নাসা

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের শুরুর দিকের কিছু ছোট লাল বিন্দুর ছবি তুলেছিল। বিজ্ঞানীরা প্রথমে এগুলোকে বামন গ্যালাক্সি ভেবেছিলেন। কিন্তু ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁরা নিশ্চিত হলেন, এগুলো আসলে ‘ব্ল্যাকহোল স্টার’। বিগ ব্যাংয়ের মাত্র ১০০ কোটি বছরের মধ্যেই বিশাল গ্যাসের মেঘের ভেতর জন্ম নেওয়া এই দানবীয় ব্ল্যাকহোলগুলো মহাবিশ্বের শুরুর দিকের ইতিহাস নতুন করে লিখতে বাধ্য করছে।

আরও পড়ুন

প্রতিবেশীর ঘরে নতুন গ্রহ

গত বছর জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে এই সম্ভাব্য গ্রহটি ধরা পড়েছিল
ছবি: নাসা

আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রমণ্ডল আলফা সেন্টাউরি এবং বার্নার্ডস স্টারে নতুন গ্রহের খোঁজ মিলেছে। বার্নার্ডস স্টারের চারপাশে পৃথিবীর ভরের এক-তৃতীয়াংশ ভরের একটি পাথুরে গ্রহের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আলফা সেন্টাউরি-এ নক্ষত্রের চারপাশে শনির মতো একটি গ্যাসীয় গ্রহের খুব জোরালো প্রমাণ পেয়েছে।

এ ব্যাপারে আরও পড়ুন: পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রমণ্ডলে নতুন গ্রহ পাওয়ার সম্ভাবনা

মিল্কিওয়ে ও অ্যান্ড্রোমিডার সংঘর্ষ কি এড়ানো যাবে

এত দিন আমরা জানতাম, আজ থেকে ৪০০-৫০০ কোটি বছর পর আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে ও প্রতিবেশী অ্যান্ড্রোমিডার মধ্যে এক বিশাল সংঘর্ষ হবে। কিন্তু নতুন সিমুলেশন বলছে, এই সংঘর্ষ না হওয়ার সম্ভাবনাও ৫০-৫০! অর্থাৎ আমাদের গ্যালাক্সি হয়তো অক্ষতও থেকে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে আরও পড়ুন: মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডা কি সত্যিই ধাক্কা লাগবে

মহাবিশ্বের সবচেয়ে ভারী ব্ল্যাকহোল

কসমিক হর্সশুতে সম্ভবত এখন পর্যন্ত পরিমাপ করা সবচেয়ে বড় কৃষ্ণগহ্বর লুকিয়ে আছে
ছবি: নাসা

২০২৫ সালে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে ভারী ব্ল্যাকহোলটি খুঁজে পেয়েছেন। এর ভর সূর্যের ভরের চেয়ে ৩ হাজার ৬০০ কোটি গুণ বেশি! এটি কসমিক হর্সশু নামে এক বিশাল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত। এর আগে এত ভারী ব্ল্যাকহোলের কথা শোনা গেলেও, এবারের মতো সরাসরি এবং নির্ভুল পরিমাপ আগে কখনো পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

রুবিন মানমন্দিরের প্রথম আলো

চিলিতে অবস্থিত ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই বছর তার কার্যক্রম শুরু করেছে। এর ৩২০০ মেগাপিক্সেলের বিশাল ক্যামেরা দিয়ে প্রতি রাতে ২০ টেরাবাইট ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটি ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে আরও পড়ুন: ভেরা রুবিন টেলিস্কোপের প্রথম ছবি প্রকাশ

মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘূর্ণায়মান বস্তু

ছবি: ইউনিভার্স টুডে

বিজ্ঞানীরা ৫ কোটি আলোকবর্ষ দীর্ঘ এক ডার্ক ম্যাটার ফিলামেন্টের খোঁজ পেয়েছেন, যা লাট্টুর মতো ঘুরছে! এর ভেতরে থাকা প্রায় ৩০০টি গ্যালাক্সি একই দিকে ঘুরছে। এটি এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বে পাওয়া সবচেয়ে বড় ঘূর্ণায়মান কাঠামো।

আরও পড়ুন

ভিনগ্রহের চাঁদ

এক্সো-মুন HD 206893 B
ছবি: নাসা

আমাদের সৌরজগতের বাইরে গ্রহ বা এক্সোপ্ল্যানেট অনেক পাওয়া গেলেও, তাদের চাঁদ বা এক্সো-মুন খুঁজে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ২০২৫ সালে ১৩৩ আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহে সম্ভবত প্রথম এক্সো-মুনের খোঁজ মিলেছে। সেটির নাম রাখা হয়েছে HD 206893 B। যদিও এটি নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

শনি গ্রহের ১২৮টি নতুন চাঁদ আবিষ্কার

বিজ্ঞানীরা শনির চারপাশে আরও ১২৮টি নতুন চাঁদের সন্ধান পেয়েছেন
ছবি: নাসা

সৌরজগতের সবচেয়ে বেশি চাঁদের মালিক হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে শনি গ্রহ। চলতি বছর মার্চ মাসে বিজ্ঞানীরা শনির চারপাশে ১২৮টি নতুন চাঁদের সন্ধান পেয়েছেন। শনির এখন মোট চাঁদের সংখ্যা ২৭৪টি। অন্যদিকে গ্রহরাজ বৃহস্পতির চাঁদ ৯৫টি। শনি গ্রহ ছাড়া আর কোনো গ্রহের ১০০টি চাঁদ নেই। তাইওয়ানের তাইপেতে অবস্থিত অ্যাকাডেমিয়া সিনিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড অ্যাশটন ও তাঁর সহকর্মীরা কানাডা-ফ্রান্স-হাওয়াই টেলিস্কোপ ব্যবহার করে শনির চারপাশে এই নতুন চাঁদগুলো শনাক্ত করেছেন। তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে শনি গ্রহের ছবি তুলেছিলেন এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে আগের বিজ্ঞানীদের না দেখা অনেকগুলো চাঁদ খুঁজে পান।

এ ব্যাপারে আরও পড়ুন: শনি গ্রহের ১২৮টি নতুন চাঁদ আবিষ্কার

১০

প্রথমবার মঙ্গল গ্রহে বজ্রপাতের শব্দ রেকর্ড

মঙ্গলের ধূলিঝড়ের মাঝে সৃষ্ট সম্ভাব্য বজ্রপাতের একটি কাল্পনিক চিত্র
ছবি: মার্ক গার্লিক/সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি/গেটি

পৃথিবীতে ঝড় হলে বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘ ডাকে। মঙ্গল গ্রহেও কি তেমনটা হয়? যদি হয়ও, সেখানে তো শোনার মতো কেউ নেই! তাহলে কি সেই বজ্রপাতের শব্দকে আদৌ ‘শব্দ’ বলা যাবে? অবশেষে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলল চলতি বছর নভেম্বরে। মঙ্গলের বুকে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ চমকানোর ঘটনা রেকর্ড করেছে নাসা। তাও একবার-দুবার নয়, গত দুই বছরে অন্তত ৫৫ বার! বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গলে বিদ্যুতের খেলা চলে ধুলোর সাহায্যে। লাল গ্রহে যখন বিশাল ধুলোঝড় বা ছোট ছোট ঘূর্ণিবাতাস তৈরি হয়, তখন ধুলোর কণাগুলো একে অপরের সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে ঘষা খায়। এই ঘর্ষণের ফলে সেখানে স্থির তড়িৎ তৈরি হয়। আগ্নেয়গিরির ছাইয়ের মধ্যে যেমন বিদ্যুৎ চমকায়, ব্যাপারটা ঠিক তেমন। পারসিভিয়ারেন্স রোভার সেই প্রমাণ হাতেনাতে ধরেছে।

 এ ব্যাপারে আরও পড়ুন: প্রথমবার মঙ্গল গ্রহে বজ্রপাতের শব্দ রেকর্ড করল নাসা

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: স্পেস ডটকম ও ডব্লিউআইওএন নিউজ