বিজ্ঞানচিন্তার চোখে জীববিজ্ঞানের আলোচিত ১০

প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে মানুষ এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও ভালোভাবে গবেষণা করতে পারছে। জীববিজ্ঞান নিয়েও এ বছর হয়েছে প্রচুর গবেষণা। বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে সেসব আলোচিত গবেষণার খবর। পাশাপাশি বছর শেষে কোয়ান্টাম ম্যাগাজিন, সায়েন্টিফিক আমারেকান, স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে সারা বছরের আলোচিত বিভিন্ন গবেষণার তালিকা। সেখান থেকে আলোচিত ১০টি গবেষণা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো এখানে।

ছবি: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন

ফিরে এল ডায়ার উলফ

ডায়ার উলফ
ছবি: জন ডেভিডসন

গেম অব থ্রোন্স-এর সেই বিশাল নেকড়ে বা ডায়ার উলফের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? ১০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছিল এরা। কিন্তু এই বছরেই কোলোসাল বায়োসায়েন্সেস দাবি করল, তারা জিন এডিটিং করে ডায়ার উলফের মতো দেখতে প্রাণী তৈরি করেছে! নাম রাখা হয়েছে রোমুলাস, রেমাস আর খালিসি। বিজ্ঞানীরা ধূসর নেকড়ের ডিএনএতে প্রাচীন ডায়ার উলফের বৈশিষ্ট্য বসিয়ে এদের জন্ম দিয়েছেন। যদিও গবেষকেরা বলছেন, এগুলো পুরোপুরি আসল ডায়ার উলফ নয়। তবু বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনার পথে এটি এক বিশাল ব্যাপার।

আরও পড়ুন

ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন প্রোটিন

ছবি: গেটি ইমেজ

ডিএনএ নষ্ট হয়ে যায় দ্রুত, কিন্তু প্রোটিন টিকে থাকে অনেক দিন। সেই ভরসাতেই বিজ্ঞানীরা এবার বাজিমাত করলেন। কানাডার আর্কটিক অঞ্চলে পাওয়া এক গন্ডারের দাঁত থেকে তাঁরা ২ কোটি ৪০ লাখ বছরের পুরোনো প্রোটিন উদ্ধার করেছেন! এর আগের রেকর্ডটি ছিল মাত্র ৩৫ লাখ বছরের। এই আবিষ্কারের ফলে ডাইনোসর যুগের প্রাণীদের সম্পর্কে জানার নতুন দরজা হয়তো খুলে গেল।

আরও পড়ুন

হরমোন ছাড়াই মেনোপোজের চিকিৎসা

ছবি: ট্যালন ওয়েলনেস

নারীদের মেনোপোজের সময় শরীর হঠাৎ গরম হয়ে যাওয়ার সমস্যায় অনেকেই ভোগেন। এত দিন এর প্রধান চিকিৎসা ছিল হরমোন থেরাপি। কিন্তু এই থেরাপি ক্যানসার বা অন্য রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ২০২৫ সালে এল লিংকুয়েট নামে নতুন ওষুধ। এটি সরাসরি মস্তিষ্কের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী নিউরনের ওপর কাজ করে। এতে হরমোন ছাড়াই মিলবে স্বস্তি।

আরও পড়ুন

সুঁচের ভয় আর নয়

ছবি: স্কাই নিউজ

শিশুদের অ্যালার্জির চিকিৎসায় এত দিন এপিনেফ্রিন ইনজেকশনই ছিল ভরসা। কিন্তু সুঁচের ভয়ে শিশুরা (অনেক সময় বড়রাও) পিছিয়ে যেত। তিন দশক পর এল এক দারুণ সমাধান—নেফি। এটি একটি নেজাল স্প্রে। মানে নাকে স্প্রে করলেই ওষুধ রক্তে মিশে গিয়ে অ্যালার্জির মারাত্মক বিক্রিয়া থামিয়ে দেবে। চার বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য এটি এক জীবন রক্ষাকারী চমক।

আরও পড়ুন

মানুষের অঙ্গ গজাবে আবার!

ছবি: জিনোম বিসি

টিকটিকি বা সালাম্যান্ডার লেজ কাটা গেলে আবার গজাতে পারে, মানুষ কেন পারে না? বিজ্ঞানীরা এবার সেই রহস্যের খুব কাছে। তাঁরা এমন এক এনজাইম ও জিন খুঁজে পেয়েছেন, যা সালাম্যান্ডারের অঙ্গ গজাতে সাহায্য করে। মানুষের শরীরেও এই মলিকিউলার উপাদান আছে। হয়তো খুব শিগগির মানুষও হারানো অঙ্গ ফিরে পাবে! ইতিমধ্যে বানরের হৃৎপিণ্ডে ল্যাবে তৈরি স্টেম সেল দিয়ে হার্ট প্যাচ বসিয়ে সফলতাও পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন

একজনের জন্য জিন এডিটিং

ছবি: বিবিসি

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক অভূতপূর্ব ঘটনা এটি। বেবি কেজে নামে এক শিশু জন্মেছিল বিরল এক জিনগত রোগ নিয়ে। এই রোগের কারণে শিশুটির লিভার বিষাক্ত অ্যামোনিয়া ভাঙতে পারত না। ডাক্তাররা শুধু তার জন্য বিশেষায়িত ক্রিসপার জিন এডিটিং থেরাপি তৈরি করলেন। লিপিড ন্যানোপার্টিক্যালের মাধ্যমে সেই ওষুধ লিভারে পৌঁছে ত্রুটিপূর্ণ জিনটি সারিয়ে তুলল। ফলে এখন আর এক ওষুধ সবার জন্য নয়, বরং এবার চিকিৎসাবিজ্ঞান এগোচ্ছে ব্যক্তিগত চিকিৎসার দিকে।

আরও পড়ুন

টিকার বোনাস সুবিধা

ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

আমরা নির্দিষ্ট রোগ থেকে বাঁচতে টিকা নিই। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেল, শিংলসের টিকা নিলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে ১৬ শতাংশ। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও কমে ১৮ শতাংশ! আবার ক্যানসার রোগীরা ইমিউনোথেরাপির পাশাপাশি কোভিডের টিকা নিলে টিউমারের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি বাড়ছে। অর্থাৎ, টিকা শুধু রোগই ঠেকায় না, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বুস্ট করে অন্য বড় বিপদ থেকেও বাঁচায়।

আরও পড়ুন

শুরুতেই ক্যানসারকে রুখে দেওয়া

ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার খুবই মারাত্মক। এটি ধরা পড়ে খুব শেষ পর্যায়ে গিয়ে। কিন্তু ২০২৫ সালে বিজ্ঞানীরা এমন এক উপায় বের করেছেন, যাতে ক্যানসার হওয়ার আগেই তাকে চিনে ফেলা যায়। তাঁরা দেখেছেন, FGFR2 নামের একটি প্রোটিনকে ব্লক করে দিলে ক্যানসার হওয়ার আগের কোষগুলো মারাত্মক হতে পারে না। পারিবারিক ইতিহাস যাদের আছে, তাদের জন্য এটি এক বিশাল সুখবর।

আরও পড়ুন

ওজেম্পিক রহস্য এবং মস্তিষ্কের খেলা

ওজেম্পিক
ছবি: বিবিসি

ওজন কমানোর ওষুধ ওজেম্পিকের (GLP-1 drugs) নাম হয়তো শুনেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এবার এর গভীরের খবর পেলেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন কেন এই ওষুধ খেলে হঠাৎ প্রিয় খাবার বিস্বাদ লাগে বা কেন অনেকে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়। এমনকি দেখা যাচ্ছে, এই ওষুধ খেলে অ্যালকোহল পানের ইচ্ছাও কমে যায়! অন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের এই গোপন সংযোগের রহস্যভেদ এ বছর নতুন মোড় নিয়েছে।

আরও পড়ুন
১০

থ্রিডিতে মানুষের ভ্রূণ প্রতিস্থাপন

ছবি: মিডজার্নির সাহায্যে

মানুষের জীবনের শুরুটা ঠিক কীভাবে হয়? মায়ের জরায়ুতে ভ্রূণটা কীভাবে গেঁথে যায়? এত দিন এই দৃশ্য ছিল অনেকটা রহস্যের চাদরে ঢাকা। কিন্তু এবার সেই পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। প্রথমবারের মতো গবেষকেরা মানুষের ভ্রূণ জরায়ুর টিস্যুতে ইমপ্লান্টেশনের দৃশ্য একদম সরাসরি ভিডিও করেছেন। তাও আবার সাধারণ কোনো ভিডিও নয়, একদম রিয়েল-টাইম থ্রিডি ভিডিও! অবশ্য ঘটনাটি কোনো মায়ের শরীরে ঘটেনি। ল্যাবে তৈরি কৃত্রিম জরায়ু টিস্যুতে এই পরীক্ষা চালানো হয়েছে। যদিও এই ল্যাব ম্যাট্রিক্স সরাসরি টেস্ট টিউব বেবির জন্য ডিজাইন করা হয়নি, তবু গবেষকরা বলছেন, এই ফুটেজ চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন এক দরজা খুলে দিয়েছে। বন্ধ্যাত্ব বা মিসক্যারেজের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ভ্রূণ ঠিকমতো জরায়ুতে বসতে না পারা। এই লাইভ ভিডিও বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এখন হয়তো বুঝতে পারবেন, ঠিক কেন এবং কীভাবে এই সমস্যা হয়। ফলে ভবিষ্যতে আইভিএফ প্রযুক্তি আরও নিখুঁত ও সফল হবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: কোয়ান্টাম ম্যাগাজিন, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিস্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন

আরও পড়ুন