ধারাবাহিক
দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি – ৯
মাদ্রাজের সামান্য কেরানি থেকে কেমব্রিজের ফেলো—শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন যেন এক রূপকথা। দেবী নামাগিরি নাকি স্বপ্নে এসে তাঁকে জটিল সব সূত্র বলে যেতেন! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন। তাঁর এই নাটকীয় জীবন নিয়েই রবার্ট কানিগেল লিখেছেন দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি। রামানুজনের সেই জীবনী ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন কাজী আকাশ।
১৯০৩ সাল। রামানুজন তখনো টাউন হাইস্কুল ছাড়েননি। ঠিক সেই সময়েই বইটা তাঁর হাতে এল। সম্ভবত তাঁর বাড়িতে থাকা কলেজপড়ুয়া কোনো ছাত্র বইটা তাঁকে দেখিয়েছিলেন। বইটার নাম বেশ খটমটে—আ সিনোপসিস অব এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস। নাম দেখে বোঝার উপায় ছিল না, এ বইই তাঁর জীবন বদলে দেবে।
সহজ কথায়, বইটা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার সমীকরণের একটা সংকলন। একের পর এক উপপাদ্য, সূত্র আর জ্যামিতিক নকশা দিয়ে সাজানো। প্রতিটি বিষয়ের পাশে বড় বড় নম্বর দেওয়া। এতে বিষয়গুলো খুঁজে পেতে সুবিধা হতো। বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, ক্যালকুলাস, স্থানাঙ্ক জ্যামিতি থেকে শুরু করে ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন—কী নেই সেখানে!
ঊনবিংশ শতাব্দীর গণিতের প্রায় সব বড় বিষয়ই এখানে ছিল। তবে একে মোটা টেক্সটবই ভেবে ভুল করবেন না! মাত্র দুটি খণ্ডের মধ্যে সব কিছু ঠাসা ছিল। অবশ্য দ্বিতীয় খণ্ডটি রামানুজন হয়তো আরও পরে দেখেছিলেন।
পরে কেউ একজন এই বই সম্পর্কে বলেছেন, ‘বইটা আসলে তেমন আহামরি কিছু নয়। রামানুজনই একে বিখ্যাত করে দিয়েছেন।’
ঊনবিংশ শতাব্দীর গণিতের প্রায় সব বড় বিষয়ই আ সিনোপসিস অব এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস বইটিতে ছিল। মাত্র দুটি খণ্ডের মধ্যে সব কিছু ঠাসা ছিল এই বইয়ে।
এ বইয়ের লেখক ছিলেন জর্জ শুব্রিজ কার। তিনি কোনো মহাগণিতবিদ ছিলেন না। ছিলেন মাঝারি মানের এক গণিতবিদ। লন্ডনে প্রাইভেট পড়াতেন। ছাত্র পড়ানোর সময় নিজের জন্য কিছু নোট তৈরি করেছিলেন তিনি। সেগুলোর সারসংক্ষেপই ছিল এ বই।
উনিশ শতকের শেষ দিক। ইংল্যান্ডের গণিতের শিক্ষার্থীদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ‘কুখ্যাত’ ট্রাইপস পরীক্ষায় ভালো করা। কারণ এই পরীক্ষার ফলের ওপরই নির্ভর করত তাদের ভবিষ্যৎ। বর্তমানের শিক্ষাবিদেরা একে হয়তো ‘টিচিং টু দ্য টেস্ট’ বলতেন। মানে শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়ানো। ১৮৬০-এর দশকে এই প্রথার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলত না। পরীক্ষার গুরুত্ব বুঝে ছাত্রদের কোচিং করানোর জন্য প্রাইভেট টিউটরদের রীতিমতো একটা বাহিনী গড়ে উঠেছিল। জর্জ কার ছিলেন তাদেরই একজন।
কারের নিজের একাডেমিক জীবনটাও ছিল বেশ অদ্ভুত। ১৮৩৭ সালে টেইনমাউথ শহরে তাঁর জন্ম। ফ্রান্সের কাছে জার্সি আইল্যান্ডের এক স্কুলে পড়ালেখা করেন তিনি। পরে ভর্তি হন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ স্কুলে। ১৮৬৬ সাল বা তার আগে থেকেই তিনি টিউশনি শুরু করেন। কাজটা করতেন বেশ গুরুত্ব দিয়েই। ছাত্রদের পড়ার সুবিধার্থে নিজের নোটগুলো নিয়মিত আপডেট করতেন। বের করতেন সহজ শর্টকাট।
এরপর ৩৮ বছর বয়সে তিনি হুট করে আবার পড়াশোনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই ভর্তি হন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির গনভিল অ্যান্ড কিজ কলেজে। ১৮৮০ সালে পেলেন বিএ ডিগ্রি। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সে পাস করলেন এমএ।
তবে তিনি কিন্তু ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিলেন না। ট্রাইপস পরীক্ষায় তিনি ছিলেন সিনিয়র অপটিমস ক্যাটাগরির। সেরা ছাত্রদের দল র্যাংলারের তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। তিনি জানতেন, গণিতের আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তিনি নন। তাই বইয়ের মুখবন্ধে বিনয়ের সঙ্গে লেখেন, ‘আমার চেয়ে যোগ্য কেউ হয়তো এই কাজটা আরও ভালো করতে পারতেন।’ কিন্তু তিনি এও জানতেন, সেই যোগ্য ব্যক্তিরা নতুন গাণিতিক আবিষ্কারেই ব্যস্ত থাকবেন। এসব নোট গোছানোর মতো ধৈর্য তাঁদের নেই।
জর্জ কার হয়তো বড় কোনো গণিতবিদ ছিলেন না, কিন্তু গণিতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। ১৮৮০ সালের ২৩ মে কেমব্রিজ থেকে বিএ ডিগ্রি পাওয়ার ঠিক আগমুহূর্ত লন্ডনের বাইরে হ্যাডলি শহরে বসে তিনি তাঁর সিনোপসিস বইটির প্রথম খণ্ড শেষ করেন। দ্বিতীয় খণ্ডটি বের হয় ১৮৮৬ সালে। এই বইটির মাধ্যমেই তাঁর নাম চিরকালের জন্য জড়িয়ে গেল রামানুজনের নামের সঙ্গে।
৩৮ বছর বয়সে জর্জ শুব্রিজ কার হুট করে আবার পড়াশোনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই ভর্তি হন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির গনভিল অ্যান্ড কিজ কলেজে। ১৮৮০ সালে পেলেন বিএ ডিগ্রি।
জর্জ কারের বইয়ের একটা বিশেষ গুণ ছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো সূত্রগুলো এলোমেলোভাবে সাজানো। কিন্তু এর ভেতরে একটা গোপন ছন্দ ছিল। ছিল একটা প্রলোভন।
উদাহরণ হিসেবে বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম সমীকরণটার কথা বলা যায়। সমীকরণটা এরকম:
a2 - b2 = (a - b) (a + b)
এটা একটা সমীকরণ। যেকোনো সমীকরণের মানে হলো, সমান চিহ্নের বাঁ দিকে যা আছে, তা ডান দিকের সমান। যেমন ২ + ২ = ৪। এখানে শুধু সংখ্যার বদলে ‘a’ এবং ‘b’-এর মতো প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। কিছু সমীকরণ সমাধান করতে হয়। অর্থাৎ বের করতে হয় x বা z-এর নির্দিষ্ট মান। কিন্তু এটি হলো একটি অভেদ। এর মানে, আপনি ‘a’ এবং ‘b’-এর মান যা-ই ধরুন না কেন, এই সমীকরণ সব সময় সত্য হবে।
বিশ্বাস হচ্ছে না? পরীক্ষা করে দেখুন। ধরুন a = ১১ এবং b = ৬। তাহলে a + b মানে ১১ + ৬ = ১৭। আর a − b মানে ১১ − ৬ = ৫।
এখন ব্র্যাকেটের ভেতরের অংশগুলো গুণ করলে পাবো: ১৭ × ৫ = ৮৫। এটা হলো ডান দিকের ফল।
এবার বাঁ দিকে আসি। a2 মানে অবশ্যই ১১ × ১১ = ১২১। আবার b2 মানে ৬ × ৬ = ৩৬। তাহলে a2 - b2 মানে ১২১ − ৩৬ = ৮৫। দেখলেন তো? দুপক্ষই সমান। সমীকরণটিও ঠিক আছে।
যেকোনো সমীকরণের মানে হলো, সমান চিহ্নের বাঁ দিকে যা আছে, তা ডান দিকের সমান। যেমন ২ + ২ = ৪। এখানে শুধু সংখ্যার বদলে ‘a’ এবং ‘b’-এর মতো প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে।
আপনি চাইলে বড় সংখ্যা, ছোট সংখ্যা, নেগেটিভ সংখ্যা, ভগ্নাংশ বা দশমিক সংখ্যা দিয়ে এটা পরীক্ষা করতে পারেন। কিন্তু কে এত সময় নষ্ট করতে চায়?
গণিতবিদেরা তাই বোকার মতো সংখ্যা বসিয়ে চেক করেন না। তাঁরা প্রমাণ করেন। এ জন্য তাঁরা নির্দিষ্ট সংখ্যার বদলে প্রতীকগুলো নিয়েই খেলা করেন। সাধারণ সংখ্যার মতোই ‘a’ এবং ‘b’ যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করা যায়।
এক্ষেত্রে সমীকরণটি বলছে (a − b)-কে (a + b) দিয়ে গুণ করতে। ব্যাপারটা খুব সহজ। ধরুন, আপনি ঘণ্টায় ১০ টাকা বেতন পান। কিন্তু পরে ১ টাকা বেতন কমে গেল। তাহলে মোট কত পেলেন? আপনি চাইলে মোট কর্মঘণ্টাকে ১০ দিয়ে গুণ করে পরে আবার ১ দিয়ে গুণ করে বিয়োগ করতে পারেন। অথবা সোজাসুজি ৯ দিয়ে গুণ করতে পারেন। একই কথা। এখানেও আমরা (a + b) অংশটিকে প্রথমে ‘a’ দিয়ে এবং পরে ‘b’ দিয়ে গুণ করব। তারপর করব বিয়োগ। গাণিতিক ভাষায়:
(a - b) (a + b) = a(a + b) - b(a + b)
এখন a(a + b) মানে a2 + ab। আর b(a + b) মানে ba + b2। আবার ba মানেই কিন্তু ab। যেমন ৫ × ৪ মানে যা, ৪ × ৫ মানেও তাই। তাহলে আমরা পাই:
(a - b) (a + b) = (a2 + ab) - (ab + b2)
আপনি ঘণ্টায় ১০ টাকা বেতন পান। কিন্তু পরে ১ টাকা বেতন কমে গেল। তাহলে মোট কত পেলেন? আপনি চাইলে মোট কর্মঘণ্টাকে ১০ দিয়ে গুণ করে পরে আবার ১ দিয়ে গুণ করে বিয়োগ করতে পারেন।
গণিতবিদরা মাঝেমধ্যে আমাদের মতোই একটু ঘর গোছানোর কাজ করেন। তাঁরা একই ধরনের রাশিগুলোকে এক জায়গায় সাজান। একে বলে গ্রুপিং লাইক টার্মস। আমরা যেমন ময়লা কাপড় লন্ড্রিতে আর পরিষ্কার কাপড় আলমারিতে রাখি, এখানে তেমন ব্র্যাকেট তুলে সব রাশি বাইরে বের করে আনি। তখন একটা মজার ব্যাপার ঘটে।
এক্ষেত্রে, +ab এবং -ab একে অপরকে নাকচ করে দেয়। মানে ab গায়েব হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু a2 - b2। এটাই তো আমাদের মূল সমীকরণের বাঁ দিকের অংশ! অর্থাৎ প্রমাণিত।
গণিতবিদরা হয়তো এটাকে খুব একটা জাঁদরেল প্রমাণ বলবেন না। কিন্তু এটা অন্তত দেখিয়ে দেয় যে, কারের সূত্রটি সঠিক। আমাদের আর a = ৭৩৫ বা b = ০.০২৩১ বসিয়ে চেক করার দরকার নেই। আমরা জানি এটা কাজ করবে, কারণ সাধারণ ক্ষেত্রটা আমরা আগেই প্রমাণ করে ফেলেছি।
কারের দ্বিতীয় সমীকরণটি ছিল এমন:
a3 - b3 = (a - b) (a2 + ab + b2)
এটা প্রমাণের নিয়মও আগের মতোই। গুণ করা, যোগ করা, কাটাকাটি করা এবং শেষে দেখা প্রমাণ করা যে, দুই পাশ সমান। তাই এটা নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই…
আর ঠিক এখানেই কারের শিক্ষাদানের জাদুটা লুকিয়ে আছে। প্রথম সমীকরণ থেকে দ্বিতীয় সমীকরণে যাওয়ার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। কার আমাদের কোথাও একটা নিয়ে যেতে চাইছেন। প্রথমটা ছিল বর্গের সূত্র, দ্বিতীয়টা ঘনের। তাহলে এরপর কি পাওয়ার ৪ বা a4 আসবে?
কার সেটা দেননি। কারণ ওটা দেওয়া একঘেয়ে বা বিরক্তিকর হতো। তিনি এক লাফে চলে গেলেন সাধারণীকরণে:
an - bn = (a - b) (an-1 + an-2 b + . . . bn-1)
এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ। কারণ এখানে আর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। ২, ৩ বা ৮ নয়, এখানে আছে রহস্যময় ‘n’। এখন আপনি n-এর জায়গায় যেকোনো সংখ্যা বসিয়ে দিলেই সূত্রটি কাজ করবে। মাঝখানের ওই তিনটি ফোঁটা বা ইলিপসিস (...) মানে, এই ধারা একইভাবে চলবে।
গণিতবিদরা হয়তো এটাকে খুব একটা জাঁদরেল প্রমাণ বলবেন না। কিন্তু এটা অন্তত দেখিয়ে দেয় যে, কারের সূত্রটি সঠিক। আমাদের আর a = ৭৩৫ বা b = ০.০২৩১ বসিয়ে চেক করার দরকার নেই।
গণিতবিদরা বলবেন, ‘n’-এর এই সমীকরণটি আগের দুটির চেয়ে অনেক বেশি সাধারণ। রামানুজন নিশ্চয়ই প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেলেছিলেন আসল ব্যাপারটা। আগের দুটি সূত্র আসলে এই তৃতীয় সূত্রটিরই বিশেষ রূপ। কার এভাবেই ছাত্রদের হাত ধরে গণিতের নতুন জগতে নিয়ে যেতেন।
তবে কারের বইয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল অন্য জায়গায়। তিনি প্রমাণগুলো দিতেন না।
সেকালের সাধারণ গণিতের বইগুলোতে একটা উপপাদ্য দেওয়ার পর ধাপে ধাপে তার প্রমাণ দেওয়া থাকত। শিক্ষার্থীরা শুধু সেটা পড়ে বুঝত আর বলত, ‘ওহ আচ্ছা, এভাবে এসেছে!’ কিন্তু গণিত তো প্রেমকাহিনির মতো শুয়ে-বসে পড়ার জিনিস নয়। দাবা খেলার মতো মগজ খাটিয়ে এখানে আক্রমণ করতে হয়। অন্যের করে দেওয়া প্রমাণ মুখস্থ করলে সেটা শেখা যায় না। এর আগে এস.এল.লোনির ট্রিগোনোমিট্রি বই শেষ করেছিলেন রামানুজন। কিন্তু সেটাও ছিল গতানুগতিক। সেই বই আপনাকে শুধু পথ দেখাবে, আর আপনি শুধু অনুসরণ করবেন।
কারের বই ছিল অন্য রকম। সিনোপসিস বইয়ে বিস্তারিত প্রমাণের কোনো জায়গাই ছিল না। অনেক সময় কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই শুধু ফলাফল লিখে দেওয়া হতো। কখনো কখনো ছোট্ট একটা নোট থাকত। যেমন উপপাদ্য ২৪৫-এর পাশে লেখা: ‘বাই (২৪৩), (২৪৪)’। মানে ২৪৩ আর ২৪৪ নম্বর উপপাদ্যের যুক্তি ব্যবহার করলেই এটা পাওয়া যাবে। আবার উপপাদ্য ২৯১২-এর পাশে লেখা: ‘প্রুফ—বাই চেঞ্জিং x ইনটু πx ইন (২৯১১)’। অর্থাৎ, ২৯১১ নম্বর সূত্রে x-এর জায়গায় πx বসালেই কেল্লাফতে! তিনি ধাপে ধাপে কোনো সমাধান দেননি। শুধু ইশারা দিয়ে পথ দেখিয়েছেন।
পণ্ডিতরা হয়তো পরে কারের বই নিয়ে অনেক গবেষণা করবেন। খুঁজবেন এর মধ্যে কী এমন জাদু ছিল। কেউ হয়তো বলবেন ইনডেক্সটা ভালো ছিল। আবার কেউ বলবেন অনেক বিষয় ভালো ছিল না।
গণিত তো প্রেমকাহিনির মতো শুয়ে-বসে পড়ার জিনিস নয়। দাবা খেলার মতো মগজ খাটিয়ে এখানে আক্রমণ করতে হয়। অন্যের করে দেওয়া প্রমাণ মুখস্থ করলে সেটা শেখা যায় না।
কিন্তু সত্য হলো, রামানুজনের মতো এক বিস্ময়কর কিশোরের জন্য এর চেয়ে ভালো বই আর হতে পারত না। কারণ ফলাফলের প্রমাণ না দিয়ে কার যেন তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। রামানুজনের কাছে প্রতিটি উপপাদ্য ছিল একেকটা গবেষণার প্রজেক্ট। অথবা একটা ক্রসওয়ার্ড পাজল, যার খালি ঘরগুলো পূরণের অপেক্ষায় আছে।
এটা কিন্তু কাকতালীয় ছিল না। ইচ্ছে করেই এমনটা করেছিলেন কার। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি অনেক ক্ষেত্রে শুধু মূল পয়েন্টগুলো বলে দিয়েছি... কোনো গাণিতিক প্রমাণ শুধু পড়ার চেয়ে নিজে তৈরি করার আনন্দ অনেক বেশি। বিষয়টা অনেকটা এমন: আপনি একটা অচেনা দেশে ভ্রমণ করছেন। প্রথম ক্ষেত্রে আপনি চুপচাপ বসে আছেন, আর কেউ আপনাকে ধরে ধরে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আপনি দেখছেন, আনন্দ পাচ্ছেন, কিন্তু নিজের কোনো চেষ্টা নেই। আরেক ক্ষেত্রে আপনার হাতে আছে শুধু একটা মানচিত্র। রাস্তা আপনাকেই খুঁজে নিতে হচ্ছে, কোথায় যাবেন তাও আপনাকেই বুঝে নিতে হচ্ছে। এতে কষ্ট একটু বেশি, কিন্তু আগ্রহটা অনেক বেশি। এর আনন্দও অন্যরকম।
কিন্তু কার তো ঠিকমতো ম্যাপও দেননি! তাঁর নির্দেশনা ছিল অনেকটা এমন; শহর পার হয়ে বাঁয়ে মোড় নেবেন।
রামানুজনের কাজকে খুব কাছ থেকে দেখা এক পশ্চিমা গণিতবিদ পরে একটি কথা বলেছিলেন। কারের বই রামানুজনকে পথ দেখিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর পদ্ধতির সঙ্গে কারের কোনো সম্পর্ক ছিল না। রামানুজনের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ মৌলিক। আসলে কারের বইয়ে কোনো পদ্ধতিই ছিল না। তাই পাঁচ হাজার উপপাদ্যের ওই গভীর জঙ্গলে ঢুকে রামানুজনকে নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নিতে হয়েছিল।
রামানুজনও তাই করেছিলেন। তাঁর দুই ভারতীয় জীবনীকার পরে লিখেছিলেন, ‘নতুন এক জগৎ তাঁর সামনে খুলে গেল। আর সেখানে আনন্দে ভেসে বেড়াতে লাগলেন রামানুজন।’
