উনিশ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানজগতে সবচেয়ে আলোচিত আর ব্যবহৃত যন্ত্রটির নাম ছিল ক্যাথোড রে টিউব। নিজের কাছে একখানা এই যন্ত্র রাখাটা বিজ্ঞানীদের কাছে হয়ে উঠেছিল রীতিমতো ফ্যাশনের মতো। ইউরোপের অধিকাংশ বিজ্ঞানীর কাছেই এই যন্ত্র মজুত থাকত। পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগারে বিদ্যুৎ–বিষয়ক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এর ব্যবহার ছিল। এ যন্ত্রের আরেক নাম ক্রুকস টিউব।
ক্রুকস টিউব হলো আংশিক বায়ুশূন্য একটা কাচের টিউব, যার ভেতরের দুই প্রান্তে দুটি ধাতব পাত বা ইলেকট্রোড থাকে। ইলেকট্রন দুটির একটি ক্যাথোড ও আরেকটি অ্যানোড নামে পরিচিত। ইলেকট্রোড দুটিতে উচ্চ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে ক্যাথোড থেকে একধরনের রশ্মি নিঃসৃত হতে দেখা যায়, যা অ্যানোডের দিকে প্রবাহিত হয়। ১৮৭৬ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ইউজেন গোল্ডস্টেইন এই রশ্মির নাম দেন ক্যাথোড রে বা ক্যাথোড রশ্মি। এর কারণ, পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেল, রশ্মিটা ক্যাথোড থেকে অ্যানোডের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
যন্ত্রটির উদ্ভাবক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম ক্রুকসের নামেই পরিচিতি পেয়েছিল এটি। তবে এই টিউবের আদি সংস্করণ আসলে গেইসলার টিউব। সেটিও একধরনের বায়ুশূন্য কাচনল। যন্ত্রটি দেখতে আজকের যুগের টিউবলাইটের মতো। জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক গেইসলার ১৮৫০ সালের দিকে বানিয়েছিলেন এই ভ্যাকুয়াম টিউব বা বায়ুশূন্য কাচনল।
বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদেরা বলেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে উন্নত মানের ভ্যাকুয়াম টিউবের উদ্ভাবনের কারণে বিজ্ঞানের দুনিয়ায় বড় ধরনের কিছু বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। আজকের যুগের প্রযুক্তির কাছে এই উদ্ভাবনকে তুচ্ছ মনে হতে পারে, কিন্তু এই উদ্ভাবনই আক্ষরিক অর্থে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের। বায়ুশূন্য জায়গায় বিদ্যুতের ধর্ম নিয়ে একসময় গবেষণা করতে চেয়েছিলেন মাইকেল ফ্যারাডে। সে জন্য ১৮৩০-এর দশকের শেষ দিকে একটি গ্লাসজার ব্যবহার করেন তিনি। জারটির মুখটা কর্ক দিয়ে সিল করা থাকত। কর্কের ভেতর দিয়ে একটি ইলেকট্রোড ঢোকানো হয়েছিল এই জারের ভেতর। আরেকটি ইলেকট্রোডকে ঠেলা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সরানো যেত। কাচের জারটি বায়ুশূন্য করতে তিনি যে যন্ত্র ব্যবহার করতেন, তার সঙ্গে বর্তমানের সাইকেলের পাম্পারের বেশ মিল আছে। তবে জারটিকে বায়ুশূন্য করতে অনবরত পাম্প করতে হতো। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একে আসলে বায়ুশূন্য বলা যায় না। পাত্রটির ভেতরের বায়ুচাপ খুব বেশি কমানো যেত না।
এর প্রায় ২০ বছর পর ভ্যাকুয়াম করার পদ্ধতির বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটান জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিক গেইসলার। ১৮৫০-এর দশকের শেষ দিকে পারদ ব্যবহার করে নতুন ধরনের ভ্যাকুয়াম পাম্প তৈরি করেন। এর মাধ্যমে আগের তুলনায় কাচের কোনো পাত্র থেকে বাতাস বের করে দিয়ে পাত্রটিকে অনেকটাই এয়ারটাইট করে ফেলা যেত। এভাবে কোনো কাচের নল থেকে প্রায় সব বাতাস বের করে তার ভেতর দুটি ইলেকট্রোড জুড়ে দিতে পারতেন তিনি। আবার নিজে নিজেই কাচের নলও তৈরি করতে পারতেন বিভিন্ন আকৃতির। এ যন্ত্র ব্যবহার করে গেইসলার দেখতে পান, কাচের এসব টিউবের মধ্যে নিওন ও অন্যান্য কিছু গ্যাস আটকে রেখে তার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে বিভিন্ন রঙের আলো জ্বলে ওঠে। তাঁর রংবেরঙের এই কাচনলগুলোই এখন নিওন সাইন হিসেবে শহরগুলোতে ব্যবহার করা হয় বিজ্ঞাপন বা অন্য কোনো কাজে।
পরের কয়েক দশকে গেইসলারের বায়ুশূন্য করার পদ্ধতি আরও উন্নত হয়। ১৮৮০ সালের দিকে তাঁর পদ্ধতি ব্যবহার করে আরও কাচের টিউব বানানো সম্ভব হলো। সেসব টিউবের বায়ুচাপ সমুদ্রপৃষ্ঠের বায়ুচাপের ১০ হাজার ভাগের কয়েক ভাগে নামিয়ে আনা গেল। গেইসলারের পদ্ধতি ব্যবহার করে ১৮৭৫ সালের দিকে নতুন ধরনের একটি টিউব বানান উইলিয়াম ক্রুকস। তাঁর কথা আগেই বলেছি। নতুন এই টিউবগুলো লুফে নেন বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানীরা। গেইসলারের চেয়েও তাঁর টিউব জনপ্রিয় হতে থাকে। শিগগিরই সেই টিউবের সঙ্গে তাঁর নামও জুড়ে যায়।
ক্রুকস টিউবকে কোনো ফিলামেন্ট ছাড়া একটা লাইট বাল্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সাধারণত এটি স্বচ্ছ কাচের তৈরি টিউবের দুই প্রান্তে একজোড়া ইলেকট্রোড থাকে। এর আকৃতি অনেকটা আমেরিকান ফুটবলের মতো, যার মাঝখানে মোটা এবং দুই প্রান্ত ক্রমে সরু। এই টিউবে উচ্চ ভোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে পরীক্ষা করেন ক্রুকস। তিনি দেখেন যে এতে রহস্যময় এক ক্যাথোড রশ্মি নিঃসৃত হয়। ক্রুকস টিউবে কোনো ফ্লুরোসেন্ট বা প্রতিপ্রভা পদার্থ লাগানো থাকলে ওই রশ্মি দেখা যায়। তখন ক্রুকস টিউবে সবুজ আলো জ্বলে। এসবের পেছনের কার্যকারণ নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে তখন বেশ শোরগোল চলছে। ইউরোপের সেরা গবেষণাগার এবং সেরা বিজ্ঞানীরা সেগুলো নিয়ে দিন-রাত গবেষণা করছেন এর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে। ঠিক সে সময়ে দৃশপটে হাজির হলেন জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম কনরাড রন্টজেন। এসেই বিজ্ঞানজগতে একটা হইচই বাধিয়ে দিলেন।
পর্দায় শুধু হাতের কঙ্কালের ছায়া দেখা গেল। এতে বোঝা গেল, দেহের নরম টিস্যু ভেদ করেও রশ্মিটা চলে যাচ্ছে প্রতিপ্রভা পর্দায়, কিন্তু ধাতব বস্তু বা দেহের হাড় ভেদ করে তা যেতে পারছে না। সে কারণেই প্রতিপ্রভা পদার্থে হাড়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে।
২
উইলহেম রন্টজেনের জন্ম ১৮৪৫ সালের ২৭ মার্চ। জার্মান কনফেডারেশনের প্রুশিয়ার লেনেপে। মা–বাবার একমাত্র সন্তান তিনি। বাবা ফ্রেডরিশ কনরাড রন্টজেন ছিলেন কাপড় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী। মা চারলোট কনস্টানজি ফ্রোয়িন ডাচ নাগরিক। রন্টজেনের তিন বছর বয়সে পুরো পরিবার নানার বাড়ি নেদারল্যান্ডসে পাড়ি জমায়। সেখানেই পড়ালেখার হাতেখড়ি। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি কৃতিত্বের সঙ্গে পেরিয়ে এলেও বিপত্তি বাধে হাইস্কুলে। সেখানকার পদার্থবিজ্ঞানের এক শিক্ষকের ক্যারিকেচার আঁকার অপরাধে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয় রন্টজেনকে। অবশ্য সেই ক্যারিকেচার তিনি আঁকেননি বলে শোনা যায়। অন্য এক ছাত্রের অপরাধে শাস্তি পান তিনি। কিন্তু এই শাস্তির পরও আসল অপরাধী বন্ধুর নাম বলেননি।
সে কারণে হাইস্কুল পাস করতে পারেননি তিনি। তাই অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নেদারল্যান্ডসের উট্রেচ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন। হতাশ হয়ে ১৮৬৫ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যান সুইজারল্যান্ডের জুরিখের পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে (এটি এখন ইটিএই জুরিখ নামে পরিচিত)। কারণ, স্কুল পাস না করলেও এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যেত। এখান থেকেই পরবর্তী সময়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ালেখা করেন আইনস্টাইন। পরে ১৮৬৯ সালে উট্রেচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন রন্টজেন।
জুরিখের পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে পড়ার সময় সেখানকার পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অগাস্ট কুন্দের সুনজরে পড়েন রন্টজেন। পিএইচডি শেষ করে কুন্দের পিছু পিছু জার্মানির স্ট্রাসবার্গের কাইজার-উইলহেম ইউনিভার্সিটিতে চলে যান। স্ট্রাসবার্গ তখন জার্মানির কবজায়। আর অধ্যাপক কুন্দ তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৮৭৪ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন রন্টজেন। দুই বছর পর সেখানকার পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন। ১৮৮৮ সালের দিকে জার্মানির উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান হন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার বেশ আগে থেকেই তখনকার হট টপিক ভ্যাকুয়াম টিউব বা ক্রুকস টিউব নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন রন্টজেন। ক্রুকস টিউবে বিদ্যুৎপ্রবাহের ফলে আলোর নিঃসরণ হয়, সেটা নিয়ে গবেষণা করতেন তিনি। বিশেষ করে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন। এই রশ্মির নিঃসরণ আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করা যাবে ভেবে একটি অন্ধকার ঘরে সিল করা কালো কার্টনে ক্রুকস টিউব নিয়ে পরীক্ষা চালাতেন।
অবশ্য ক্রুকস টিউব নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করলেও তেমন নতুন কিছু আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হন। ১৮৯৫ সালের দিকে এসে ভাগ্যের চাকা একটু ঘুরে গেল। সে বছরের ৮ নভেম্বর একেবারেই নতুন ঘটনা ঘটতে দেখলেন রন্টজেন। দেখলেন, ক্রুকস টিউব থেকে বেরিয়ে আসা সবুজ আলোর কারণে ৯ ফুট দূরের প্রতিপ্রভা পদার্থের পর্দা জ্বলজ্বল করছে। প্রতিপ্রভা পদার্থে আলো পড়লে তা জ্বলজ্বল করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, আলোর সঙ্গে বিক্রিয়া করে তারা জ্বলে ওঠে। কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপারটা হলো, চারপাশে মোটা অস্বচ্ছ কার্ডবোর্ড দিয়ে ক্রুকস টিউবটি ঢেকে রাখা হয়েছিল। তাহলে নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সেখান থেকে এমন কোনো অদৃশ্য আলো বেরিয়ে এসেছে, যা এই কার্ডবোর্ডের বাধা ডিঙিয়ে ৯ ফুট দূরের প্রতিপ্রভা পদার্থের পর্দায় গিয়ে আঘাত হানছে। এ থেকে রন্টজেন সিদ্ধান্তে এলেন, অদৃশ্য কোনো রশ্মির কারণে এসব প্রতিপ্রভা পদার্থ জ্বলে উঠছে। আর সেই রশ্মি কোনো উপায়ে বেরিয়ে আসছে অস্বচ্ছ কালো কার্ডবোর্ডের কাগজ ভেদ করে, নতুন রহস্যের গন্ধ পেলেন তিনি।
রহস্য উদ্ঘাটনের নেশায় বুঁদ হয়ে গেলেন রন্টজেন। তাঁর ল্যাবটা ছিল তাঁদের বাড়ির ঠিক নিচতলায়। কিন্তু ল্যাব ছেড়ে ঘরে ফিরতেও যেন ভুলে গেছেন। দিন-রাত গবেষণাগারেই পড়ে থাকেন। খাওয়া বা ঘুমও চলছে ওই গবেষণাগারে। ক্রুকস টিউব আর প্রতিপ্রভা পর্দার মাঝখানে বিভিন্ন পদার্থ রেখে পরীক্ষা করলেন রন্টজেন। বইপত্র, কাঠ, রাবার, চাবি, কাপড়, কয়েন বা অন্যান্য ধাতব বস্তু—কিছুই বাদ দিলেন না। এভাবে বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। সর্বশেষ দেখা গেল, অধিকাংশ পদার্থই ভেদ করে অনায়াসে চলে যাচ্ছে ওই রহস্যময় রশ্মি। একসময় নিজের হাতটাও রশ্মির সামনে রেখে পরীক্ষা করে দেখলেন। অবাক কাণ্ড, পর্দায় শুধু হাতের কঙ্কালের ছায়া দেখা গেল। এতে বোঝা গেল, দেহের নরম টিস্যু ভেদ করেও রশ্মিটা চলে যাচ্ছে প্রতিপ্রভা পর্দায়, কিন্তু ধাতব বস্তু বা দেহের হাড় ভেদ করে তা যেতে পারছে না। সে কারণেই প্রতিপ্রভা পদার্থে হাড়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে।
এরপর নতুনভাবে রহস্যময় রশ্মিটি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখার কথা ভাবলেন রন্টজেন। তিনি ঘুরে বেড়াতে এবং ছবি তুলতে পছন্দ করতেন। তাই তাঁর ল্যাবেই সব সময় মজুত থাকত ক্যামেরা, ফটোগ্রাফিক প্লেটসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম। ফটোগ্রাফিক প্লেটে রহস্যময় এই রশ্মির প্রভাব কেমন, তা যাচাই করতে চাইলেন। পরীক্ষা শেষে আরেকবার চোখ কপালে উঠে গেলে রন্টজেনের। ফটোগ্রাফিক প্লেট ডেভেলপ করে দেখা গেল, প্রতিপ্রভা পর্দায় দেখা ছায়ার মতো একই ধরনের স্থায়ী ছায়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে। এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা গেল না। কোনো কিছু জানা না থাকলে বা অজানা রাশিকে গণিতে এক্স (X) দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। গণিতের সেই চিহ্নই ব্যবহার করে অজানা রশ্মিটিকে বিজ্ঞানী রন্টজেন নাম দিলেন এক্স-রে। বাংলায় যাকে বলা হয় এক্স-রশ্মি বা রঞ্জন রশ্মি।
প্রায় দেড় মাস বিষয়টি গোপন রাখলেন তিনি। এরপর ২২ ডিসেম্বর ১৮৯৫ সালে মুখ খুললেন তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু, স্ত্রী অ্যানা বার্থা লুডভিগের কাছে। বাড়ি গিয়ে স্ত্রী বার্থাকে ডেকে নিচতলার ল্যাবে নিয়ে এলেন। অ্যানার বাবার ক্যাফেতে রন্টজেনের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। অ্যানা ছিলেন তাঁর চেয়ে প্রায় ছয় বছরের বড়। কিন্তু প্রথম দেখাতেই দুজন প্রেমে পড়ে যান। তাই অ্যানার পরিবারের অমতে বিয়ে করেন দুজন। এরপর রন্টজেনের সত্যিকার জীবনসঙ্গী হয়ে ওঠেন অ্যানা। সুখে-দুঃখে অ্যানাই ছিলেন রন্টজেনের বন্ধু। তাই নিজের আবিষ্কারটি প্রথম ফাঁস করেন অ্যানার কাছেই। নিজের আকস্মিক উদ্ভাবন দেখালেন স্ত্রীকে। তারপর অদৃশ্য রহস্যময় আলোতে স্ত্রী হাতের ছবিও তুললেন। কিছুক্ষণ পর সেই ছবি ডেভেলপ করে বার্থাকে দেখালেন। ছবিতে হাতের কঙ্কাল, একটা আঙুলে আবার বিয়ের আংটিও দেখা যাচ্ছে। স্বামীর আবিষ্কার দেখে মোটেও খুশি হতে পারলেন না বার্থা। ছবি দেখে ভীষণ আঁতকে উঠলেন। ছবিতে নিজের হাতের কঙ্কাল দেখে তাঁর মনে হলো, চোখের সামনে যেন নিজের মৃত্যুর ছায়া দেখছেন। আসলে সেকালে মৃত্যু ছাড়া মানবদেহের কঙ্কাল দেখাটা একটু বিরল ঘটনাই বলা চলে। তাই বার্থা বলে উঠেছিলেন, ‘আমি নিজের মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি।’
স্ত্রীর হাতের এক্স-রে ছবি তৈরি করার পর ঘটনা এগোতে লাগল বেশ দ্রুত। রন্টজেন বুঝতে পারলেন, তাঁর আবিষ্কারের অগ্রাধিকার আর গুরুত্ব সবাইকে বোঝাতে হলে শিগগিরই এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে হবে। সেটাও কোনো স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক জার্নালে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রকাশ করার নিয়মটাই আসলে এ রকম। সংবাদ সম্মেলন করে কিংবা দৈনিক পত্রিকায় খবর ছাপিয়ে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ঘোষণার আসলে কোনো মূল্য নেই। সঠিকভাবে কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালেই তা প্রকাশ করতে হবে। তাই স্থানীয় এক বৈজ্ঞানিক জার্নালের দ্বারস্থ হলেন রন্টজেন। কারণ, এটাকেই সবচেয়ে দ্রুত প্রকাশের উপায় বলে মনে হলো তাঁর কাছে। উর্জবার্গের ফিজিক্যাল মেডিকেল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর বন্ধুস্থানীয়। হাতে লেখা একটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে তাঁকেই ধরলেন রন্টজেন।
উর্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সোসাইটির প্রচলিত নিয়ম ছিল, কোনো গবেষণাপত্র প্রকাশের আগে তাদের মিটিংয়ে ওই বিষয়ে সবার সামনে বক্তব্য দিতে হয়। কিন্তু আবিষ্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে আগে গবেষণাপত্রটি জার্নালে ছাপানোর এবং পরে বক্তব্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। লেখাটি দ্রুত ছাপাখানায় চলে গেল। সোসাইটির জার্নালের ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংখ্যায় রন্টজেনের লেখাটি ছাপা হলো। প্রবন্ধের শিরোনাম: অন আ নিউ কাইন্ড অব রেস।
১৯০১ সালে চালু হওয়া পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল বিজয়ী যে বিজ্ঞানী উইলিয়াম কনরাড রন্টজেন হবেন, তাতে আর অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অবশ্য এই লেখার সঙ্গে কোনো ছবি ছাপা হলো না। তবে লেখাটি বার্লিনে এক বিজ্ঞানীর কাছে পাঠানোর সময় বার্থার হাতের এক্স-রে ছবিও পাঠানো হলো। সপ্তাহখানেক পর ৪ জানুয়ারি ১৮৯৬ সালে বার্লিনের ফিজিক্যাল সোসাইটির এক সভায় আবিষ্কারটি সবার সামনে তুলে ধরেন তিনি। সেবারই প্রথমবার জনসমক্ষে এক্স-রে ইমেজটি প্রদর্শন করা হয়।
লেখাটি আরেকবার ছাপিয়ে ছবিসহ পাঠিানো হয়েছিল অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়। তড়িঘড়ি করে ৫ জানুয়ারি ভিয়েনার খবরের কাগজে এক্স-রে ইমেজের ছবিসহ ছাপা হলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। খবরে এ আবিষ্কারের চিকিৎসাকাজে ব্যবহারের সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরা হয়। পরদিন ছাপা হলো লন্ডনের সংবাদপত্র ক্রনিকল-এ। তবে সেকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব লন্ডন খবরটিতে কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। তা সত্ত্বেও এক্স-রে আবিষ্কারের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছে গেল অতিদ্রুত। একে একে দেশ, মহাদেশ ছাড়িয়ে রাতারাতি তারকায় পরিণত হলেন রন্টজেন। তাঁর আবিষ্কারও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ভুতুড়ে এক্স-রে নিয়ে আরও গবেষণা শুরু হলো। তাঁর আবিষ্কারটিকে গুজব বা ধাপ্পাবাজি বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কারণ, সেকালে প্রায় সব বিজ্ঞানীর কাছেই ক্রুকস টিউব থাকত। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকেই রন্টজেনের মতো ফলাফল পাওয়া যেতে লাগল। সিয়িং ইজ বিলিভিং। রন্টজেনের কথা কিংবা তাঁর আবিষ্কৃত এক্স-রেকে অবিশ্বাস করার কোনো উপায় ছিল না। অচিরেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর কার্যকারিতার প্রমাণ মিলল। প্রাথমিক ভুতুড়ে ভাবটা কাটিয়ে উঠে এই আবিষ্কারের গুরুত্ব বেশ দ্রুতই অনুধাবন করতে পেরেছিল সেকালের চিকিৎসক সমাজ। কারণ, এর মাধ্যমে রোগীর ভাঙা হাড়ের অবস্থা বেশ ভালোমতো বোঝা যেত কিংবা ঠিক কোথায় সার্জারি করতে হবে, তা-ও বুঝতে সুবিধা হতো চিকিৎসকদের। মাত্র এক মাস পর, মানে ৩ ফেব্রুয়ারি কানাডায় গুলিবিদ্ধ এক রোগীর চিকিৎসায় প্রথমবারের মতো এক্স-রশ্মির ব্যবহার করলেন এক চিকিৎসক। একে একে অন্যান্য দেশের চিকিৎসকেরাও এক্স-রশ্মির ব্যবহার শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবে ১৯০১ সালে চালু হওয়া পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল বিজয়ী যে বিজ্ঞানী উইলিয়াম কনরাড রন্টজেন হবেন, তাতে আর অবাক হওয়ার কিছু নেই।
একসময় অনেকে এক্স-রের নাম বদলে রন্টজেন রশ্মি রাখার প্রস্তাব করেন। অনেক জায়গায় নতুন নাম ব্যবহারও শুরু হয়। আবার এক্স-রে ফটোগ্রাফের নাম রন্টজেনোগ্রাফ রাখার প্রস্তাবও উঠেছিল। কিন্তু তাতে আপত্তি জানান স্বয়ং রন্টজেনই। ভাগ্যিস! এমনকি বৃহত্তর স্বার্থে এক্স-রে আবিষ্কারের পেটেন্টও করাননি। তবে পরবর্তী সময়ে বিকিরণের একটা এককের নামকরণ করা হয়েছে রন্টজেনের নামে। আবার ১১১ নম্বর মৌলটির নামও রাখা হয়েছে তাঁর সম্মানে—রন্টজেনিয়াম।
এক্স-রে সম্পর্কে আজ এত কিছু জানার এবং তা মানবকল্যাণে ব্যবহারের পেছনে রয়েছে রন্টজেনের সেই আকস্মিক আবিষ্কার। শুধু তা–ই নয়, তেজস্ক্রিয়তা ও পরমাণুর গঠন আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছে তাঁর এই আবিষ্কারের প্রভাব।
৩
প্রশ্ন হলো, এই এক্স-রশ্মি আসলে কী? কোনো অদৃশ্য আলো? শুরুতে এর উত্তর কেউ না জানলেও পরবর্তী গবেষণায় এর অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বোঝা সম্ভব হয়েছে। দৃশ্যমান আলোর মতোই বিদ্যুচ্চুম্বকীয় শক্তির তরঙ্গের মতো একটা রূপ এক্স-রশ্মি। ফোটন নামের অতিক্ষুদ্র আলোক কণার মাধ্যমে যা বাহিত হয়। এসব ফোটনের শক্তিস্তর উচ্চ এবং রশ্মিগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অনেক ছোট। দৃশ্যমান আলোর সঙ্গে এক্স-রের পার্থক্য এটুকুই। এ কারণে এক্স-রশ্মি আমাদের চোখে অদৃশ্য। দৃশ্যমান ফোটন যেভাবে তৈরি হয়, ঠিক একইভাবে তৈরি হয় এক্স-রে ফোটনও।
পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে, অনেকটা সূর্যের চারপাশে গ্রহদের ঘোরার মতো। অনেকটা সৌরজগতের খুদে সংস্করণ। প্রতিটি কক্ষপথের শক্তিস্তর নির্দিষ্ট। একটা শক্তিস্তর থেকে আরেকটা শক্তিস্তরে ইলেকট্রনগুলো লাফিয়ে চলে যেতে পারে। তার উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে কিংবা নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে চলে যেতে পারে। উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে কোনো ইলেকট্রন চলে গেলে বাড়তি শক্তি ফোটন রূপে নিঃসৃত হয়। যত বেশি উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন স্তরে ইলেকট্রন লাফিয়ে যায়, নিঃসৃত ফোটনের শক্তিও তত বেশি হয়। বিষয়টাকে তুলনা করা যায়, ওপর থেকে নিচে কোনো বস্তু ফেলে দেওয়ার সঙ্গে। উচ্চতা যত বেশি হয়, ফেলা বস্তু তত বেশি আঘাতের মুখে পড়ে। এক্স-রশ্মির ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটে। ঠিক যেন খাড়া পাহাড় থেকে ঠাস করে নিচে পড়ে যাওয়ার মতো ব্যাপার।
সে কারণে এক্স-রশ্মির শক্তির পরিমাণ দৃশ্যমান আলোর চেয়ে কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার গুণ। আর এত বেশি শক্তি থাকার কারণে এক্স-রশ্মির ফোটনগুলো বেশির ভাগ পদার্থ ভেদ করে অবলীলায় চলে যায়। সে কারণেই রন্টজেন ক্রুকস টিউবের সামনে নানান ধরনের বস্তু ধরার পরও তার বেশির ভাগ বস্তু ভেদ করে চলে গিয়েছিল এক্স-রশ্মি। এক্স-রশ্মি কোন পথে যাবে আর কোথায় আটকাবে, তা নির্ভর করে কোনো বস্তু ঠিক কোন ধরনের পরমাণু দিয়ে গঠিত। অর্থাৎ পরমাণুর আকারের ওপর নির্ভরশীল। বড় আকৃতির পরমাণু বা উচ্চতর পরমাণু (যেসব পরমাণুর প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন–সংখ্যা বেশি) এক্স-রশ্মি শোষণ করে। কিন্তু ছোট আকৃতির পরমাণু (যেসব পরমাণুর প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন–সংখ্যা কম) এক্স-রশ্মি শোষণ করতে পারে না। তাই ছোট পরমাণু দিয়ে গঠিত বস্তু ভেদ করে চলে যায় এক্স-রে। যেমন আমাদের দেহের নরম টিস্যুগুলো সাধারণত ছোট আকৃতির পরমাণু দিয়ে গঠিত। তাই সেখানে এক্স-রে ভালোভাবে শোষিত হয় না। অন্যদিকে আমাদের হাড়ে থাকে ক্যালসিয়াম পরমাণু। সেগুলো বেশ বড় আকৃতির পরমাণু। তাই সেখানে এক্স-রে শোষিত হয়।
চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত আধুনিক এক্স-রে মেশিনগুলোতেও এই প্রভাব কাজে লাগানো হয়। প্রতিটি এক্স-রে মেশিনে অপরিহার্যভাবে একটা কাচের ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতরে একটা অ্যানোড এবং একটা ক্যাথোড থাকে। ক্যাথোড অনেকটা লাইট বাল্বের ভেতরে উত্তপ্ত ফিলামেন্টের মতোই। এই ফিলামেন্টের ভেতর বিদ্যুৎ চালনার মাধ্যমে তা উত্তপ্ত করা হলে সেখান থেকে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়। এই ইলেকট্রনগুলোকে এরপর ধনাত্মক চার্জযুক্ত অ্যানোডের দিকে নেওয়া হয়। অ্যানোড তৈরি হয় সাধারণত টাংস্টেন দিয়ে। ইলেকট্রনগুলো খুবই উচ্চ শক্তিসম্পন্ন হয়। সে কারণে সেগুলো খুবই দ্রুতগতিতে অ্যানোডের দিকে যেতে থাকে। দ্রুতগতিসম্পন্ন কোনো ইলেকট্রন টাংস্টেন পরমাণুতে আঘাত হানলে, তা ওই পরমাণুর নিম্ন শক্তিস্তরের একটা ইলেকট্রনকে আলগা করে খসিয়ে ফেলে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে উচ্চ শক্তিস্তর থেকে একটা ইলেকট্রনকে এসে ওই সদ্য শূন্য হওয়া জায়গাটি পূরণ করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই ইলেকট্রনটি তার বাড়তি শক্তিটি ফোটনরূপে ঝেড়ে ফেলে। এই ফোটনের শক্তি অনেক বেশি থাকে, যা বিদ্যুচ্চুম্বকীয় বর্ণালির এক্স-রে পরিসরের।
এদিকে রোগীর এক পাশে একটা ক্যামেরা রাখা থাকে, যা রোগীর দেহ ভেদ করে আসা এক্স-রের প্যাটার্ন রেকর্ড করে। সাধারণ ক্যামেরায় যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, এক্স-রে ক্যামেরার মৌলিক কার্যপদ্ধতিও তা–ই। তবে এখানে দৃশ্যমান বা সাধারণ আলোর বদলে ব্যবহার করা হয় এক্স-রে—এই যা পার্থক্য।
এক্স-রে সম্পর্কে আজ এত কিছু জানার এবং তা মানবকল্যাণে ব্যবহারের পেছনে রয়েছে রন্টজেনের সেই আকস্মিক আবিষ্কার। শুধু তা–ই নয়, তেজস্ক্রিয়তা ও পরমাণুর গঠন আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছে তাঁর এই আবিষ্কারের প্রভাব। সেটা আরেক গল্প।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: দ্য সায়েন্টিস্ট/ জন গ্রিবিন; স্ট্রেঞ্জ গ্লো/ টিমোথি জে. জরজেনসেন
আবিষ্কারের নেশায়/ আবদুল্লাহ আল–মুতী; উইকিপিডিয়া