দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি - ১০

মাদ্রাজের সামান্য কেরানি থেকে কেমব্রিজের ফেলো—শ্রীনিবাস রামানুজনের জীবন যেন এক রূপকথা। দেবী নামাগিরি নাকি স্বপ্নে এসে তাঁকে জটিল সব সূত্র বলে যেতেন! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই যিনি অসীমকে জয় করেছিলেন। তাঁর এই নাটকীয় জীবন নিয়েই রবার্ট কানিগেল লিখেছেন দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি। রামানুজনের সেই জীবনী ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন কাজী আকাশ।

অধ্যায় এক

মন্দিরের স্নিগ্ধ ছায়ায়

১৯০৪ সাল। কারের সেই জাদুকরী বইয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার ঠিক পরপরই হাইস্কুল পাস করেন রামানুজন। স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন কুম্বকোনমের গভর্নমেন্ট কলেজে। তিনি তখন এফএ ক্লাসের ছাত্র। আজকের দিনে একে হয়তো অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রির সঙ্গে তুলনা করা যায়। কিন্তু সেকালে ভারতে এর দাম ছিল অনেক বেশি।

শহরের কেন্দ্র থেকে কলেজে যেতে মিনিট বিশেক হাঁটতে হতো। টাউন হাইস্কুলের পাশ দিয়ে সোজা কাবেরী নদীর পাড়ে, তারপর ডান দিকে ঘুরে নদী বরাবর হাঁটলেই পৌঁছানো যেত কলেজের উল্টো দিকে।

বর্তমানে নদীর ওপর যে ব্রিজটা দেখা যায়, সেটা তৈরি হয়েছে ১৯৪৪ সালে। তার আগে ছোট নৌকায় নদী পার হতে হতো। মাঝেমধ্যে সাঁতার কেটেও নদী পার হতেন রামানুজন। মার্চ-এপ্রিল মাসে নদী শুকিয়ে যেত। তখন সাঁতরে নদী পার হওয়াটা খুব একটা কঠিন ছিল না।

গভর্নমেন্ট কলেজটা ছিল ছোটখাটো। শিক্ষকের সংখ্যা ছিল বড়জোর ডজনখানেক। শহরের ভালো ছাত্ররা তখন পাড়ি জমাতে শুরু করেছে মাদ্রাজের বড় বড় কলেজে। তবুও সেই সময় আর স্থান বিবেচনায় কলেজটি বেশ ভালোই ছিল। এতই ভালো যে লোকে একে দক্ষিণ ভারতের কেমব্রিজ বলে ডাকত। এই নামের পেছনে একটা কারণ ছিল কাবেরী নদী।

বর্তমানে কাবেরী নদীর ওপর যে ব্রিজটা দেখা যায়, সেটা তৈরি হয়েছে ১৯৪৪ সালে। তার আগে ছোট নৌকায় নদী পার হতে হতো। মাঝেমধ্যে সাঁতার কেটেও নদী পার হতেন রামানুজন।

কেমব্রিজ শহরের ক্যাম নদীর মতোই এটি কলেজ ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে বয়ে যেত। আরেকটি কারণ ছিল এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের সুনাম। দক্ষিণ ভারতের সমাজজীবনে তাদের প্রভাব ছিল অনেক।

১৮৫৪ সালে তাঞ্জোরের মহারানির দেওয়া জমিতে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজকুমারীরা যে ড্রেসিং কেবিন থেকে নদীর ঘাটে নামতেন, সেই সিঁড়িগুলো তখনো দেখা যেত। ১৮৭১ সাল থেকে পুরোনো দালান মেরামত আর নতুন ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৮৮০-এর দশকে এটি পুরোপুরি রূপান্তরিত হয় কলেজে। ক্যাম্পাস বড় করা হয়। বানানো হয় জিমনেসিয়াম। রামানুজন যখন সেখানে পড়তেন, তখন ৭২ জন ছাত্রের জন্য একটি হোস্টেল তৈরি হচ্ছিল। সেখানে ব্রাহ্মণদের জন্য ছিল আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা।

কলেজটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল অসাধারণ। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, পাখির কিচিরমিচির, কড়া রোদ থেকে বাঁচানো গাছের ছায়া; সব মিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশ। লতাপাতাগুলো দালানগুলোকে জড়িয়ে ধরত, যেন প্রকৃতি তার অধিকার ছাড়তে নারাজ। জায়গাটি ছিল সুন্দর, শান্ত ও নির্জন।

এই সুন্দর জায়গাটিই ছিল রামানুজনের প্রথম শিক্ষাজীবনের বিপর্যয়ের সাক্ষী।

১৮৭১ সাল থেকে গভর্নমেন্ট কলেজের পুরোনো দালান মেরামত আর নতুন ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৮৮০-এর দশকে এটি পুরোপুরি রূপান্তরিত হয় কলেজে। ক্যাম্পাস বড় করা হয়।

কারের সিনোপসিস বইটা একজন সাধারণ বা মাঝারি মানের ছাত্রের ওপর কেমন প্রভাব ফেলত, তা অনুমান করা কঠিন। কিন্তু রামানুজনের ক্ষেত্রে এটি যেন বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দিল। এত দিন তিনি অঙ্ক আর জীবনের বাকি সবকিছুর মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে চলছিলেন। কিন্তু এখন বিশুদ্ধ গণিতের প্রেমে পড়ে বাকি সব ভুলে গেলেন তিনি। তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠল শুধুই গণিত।

ইংরেজ গণিতবিদ ই.এইচ.নেভিল পরে রামানুজনের বন্ধু হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘কলেজের নিয়মকানুন তাঁকে হয়তো ইতিহাস বা ফিজিওলজির ক্লাসে সশরীরে আটকে রাখতে পারত, কিন্তু তাঁর মন ছিল মুক্ত। অথবা বলা ভালো, তাঁর মন ছিল তাঁর প্রতিভার দাস।’

ইংরেজ গণিতবিদ ই.এইচ.নেভিল

প্রফেসর যখন রোমান ইতিহাসের বক্তৃতা দিতেন, তখন বসে বসে গাণিতিক সূত্র নিয়ে খেলতেন রামানুজন। তাঁর সহপাঠী এন. হরি রাও বলেছিলেন, ‘চারপাশে কী হচ্ছে, সেদিকে তাঁর কোনো খেয়ালই থাকত না। গণিত ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।’

তিনি হরি রাওকে ম্যাজিক স্কয়ার বানানো শিখিয়েছিলেন। এই স্কয়ারে সব দিক থেকে যোগফল একই হয়। তিনি বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি আর ক্যালকুলাসের জটিল সব অঙ্ক কষতেন। মৌলিক সংখ্যা নিয়ে করতেন গবেষণা। খুঁজতেন নতুন কোনো প্যাটার্ন। লাইব্রেরিতে বিদেশি ভাষার যে কটি গণিত বই ছিল, সেগুলোও তিনি পড়ে ফেলেছিলেন। কারণ ভাষা যা-ই হোক, গণিতের প্রতীক তো সব দেশেই এক!

ইংরেজ গণিতবিদ ই.এইচ.নেভিল লিখেছেন, ‘কলেজের নিয়মকানুন তাঁকে হয়তো ইতিহাস বা ফিজিওলজির ক্লাসে সশরীরে আটকে রাখতে পারত, কিন্তু তাঁর মন ছিল মুক্ত।’

পি. ভি. শেষু আইয়ার ছিলেন গণিত অধ্যাপক। তিনি মাঝেমধ্যে ক্লাসে তাঁকে নিজের মতো অঙ্ক করতে দিতেন। রামানুজনকে লন্ডনের ম্যাথমেটিক্যাল গেজেট-এর সমস্যাগুলোও সমাধান করতেও উৎসাহ দিতেন। একদিন রামানুজন তাঁকে ইনফিনিট সিরিজ বা অসীম ধারার ওপর নিজের কিছু কাজ দেখালেন। শেষু আইয়ার সেটা দেখে বলেছিলেন, ‘অসাধারণ এবং মৌলিক।’

রামানুজনের শিক্ষক পি. ভি. শেষু আইয়ার

কিন্তু এমন প্রশ্রয় পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। বেশিরভাগ সময়ই রামানুজনের এই পাগলামিকে কেউ ভালো চোখে দেখত না। বরং যে প্রফেসরের কাছ থেকে তিনি ক্যালকুলাসের বই ধার নিয়েছিলেন, তিনি যখন দেখলেন এটা রামানুজনের অন্য পড়াশোনার ক্ষতি করছে, তখন তিনি বইটা ফেরত নিয়ে নিলেন। এমনকি শেষু আইয়ারও হয়তো ততটা সদয় ছিলেন না, যতটা তিনি পরে দাবি করেছিলেন। রামানুজন একবার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, শেষু আইয়ার ছিলেন তাঁর প্রতি ‘উদাসীন’।

এদিকে ফিজিওলজি, ইংরেজি, গ্রিক বা রোমান ইতিহাস সব গোল্লায় গেল। ১৮৯৭ সালের প্রাইমারি পরীক্ষায় তিনি অনেক বিষয়ে ভালো করে বৃত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন গভর্নমেন্ট কলেজে ফেল করে বসলেন ইংরেজি রচনাতেই। নেভিলের ভাষায়, ‘কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি ছিলেন এমন এক ছাত্র, যে কিনা গণিত ছাড়া আর কোনো বিষয়ই পড়ত না। এর শাস্তি ছিল অবধারিত। তাঁর স্কলারশিপ বাতিল করা হলো।’

একদিন রামানুজন পি. ভি. শেষু আইয়ারকে ইনফিনিট সিরিজ বা অসীম ধারার ওপর নিজের কিছু কাজ দেখালেন। শেষু আইয়ার সেটা দেখে বলেছিলেন, ‘অসাধারণ এবং মৌলিক।’

স্বভাবতই তাঁর মা রেগে আগুন হলেন। তিনি সোজা প্রিন্সিপালের কাছে গেলেন। এমন ছেলের বৃত্তি কীভাবে বাতিল হয়? অঙ্কে যার কোনো তুলনা নেই! প্রিন্সিপাল ভদ্র কিন্তু কঠোর ছিলেন। নিয়ম তো নিয়মই। তাঁর ছেলে ইংরেজিতে ডাহা ফেল করেছে। ব্যস, কথা শেষ।

রামানুজনের কাছে স্কলারশিপটা শুধু সম্মানের বিষয় ছিল না। প্রতি টার্মে টিউশন ফি লাগত ৩২ টাকা। এটা তাঁর বাবার দেড় মাসের বেতনের সমান। স্কলারশিপটা ছিল তাঁর ঢাল। এই ঢালের সাহায্যেই তিনি বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ পেতেন। এটা তাঁর খুব দরকার ছিল।

শ্রীনিবাস রামানুজন
ছবি: উইকিপিডিয়া

তবুও তিনি কয়েক মাস কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা করলেন। ক্লাস করে ১৯০৫ সালের জুলাই মাসে উপস্থিতির সার্টিফিকেটও পেলেন। কিন্তু এই চেষ্টা তাঁকে ক্লান্ত করে দিচ্ছিল। স্কলারশিপ চলে গেছে, এটা সবাই জানে। বাবা-মায়ের ওপর বাড়ছে ঋণের বোঝা। অন্য বিষয়গুলোতে পাস করার চাপ অনুভব করলেন তিনি। কিন্তু সে জন্য গণিতকে সরিয়ে রাখতেও পারলেন না। এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে গেলেন তিনি।

যত দিন সহ্য করা যায় করলেন। অবশেষে যখন আর পারলেন না, তখন ১৯০৫ সালের আগস্ট মাসের শুরুর দিকে, ১৭ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন রামানুজন।

চলবে…