তাপ ও তাপমাত্রার সম্পর্ক
মহাবিশ্বের অন্যতম শক্তি হলো তাপশক্তি। শক্তির রূপান্তর সম্ভব। তাপশক্তি অন্য শক্তিতে পরিণত করা যায়। তেমনি অন্য শক্তিকেও তাপশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এ জন্যই তাপ দিয়ে যেমন বস্তুকে উত্তপ্ত করা যায়, তেমনি তাপের সাহায্যে যন্ত্রকে দিয়ে কাজও করিয়ে নেওয়া যায়।
আবার বস্তু কতটা উষ্ণ, সেটা বোঝা যায় তাপমাত্রা থেকে। অর্থাৎ তাপ যেমন একপ্রকার শক্তি, তেমনি সেই শক্তি দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার পর একটা ফল পাওয়া যায়। সেই ফলটাই হলো তাপমাত্রা। সোজা কথায়, তাপ হলো তাপমাত্রার কারণ আর তাপমাত্রা হলো তাপের ফল।
কিন্তু কোনো বস্তুকে তাপ দিলে তার তাপমাত্রা বাড়ে কেন? কেন জ্বালানি পুড়িয়ে তাপ পাওয়া যায়? তাপ দিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হয় এবং সেই বাষ্প চালায় বাষ্পীয় ইঞ্জিনগুলোকে। সরাসরি পেট্রল-ডিজেল কিংবা গ্যাস পুড়িয়ে যে ইঞ্জিনগুলো চালানো হয়, সেগুলো সবই তাপ ইঞ্জিন। যেমন বাস-ট্রাক, ট্রেন, সাধারণ জাহাজ, উড়োজাহাজ, মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন। এগুলো কাজ করে তাপ ব্যবহার করে। আর সেটা সম্ভব হয় বস্তুর তাপীয় আচরণের বিশেষ ধর্মের জন্য।
বস্তুর তাপমাত্রিক ধর্ম কী
তাপ দিলে বেশির ভাগ পদার্থেরই আয়তন বেড়ে যায়। বিশেষ করে ধাতব পদার্থের ক্ষেত্রে। তাপ প্রয়োগে আয়তন বাড়ার এই ধর্মকেই বস্তুর তাপমাত্রিক ধর্ম বলা যেতে পারে।
তবে এখানেই শেষ নয়, বেশির ভাগ ধাতুই বিদ্যুৎ পরিবাহী। কিন্তু বিদ্যুৎ পরিবাহী যেকোনো বস্তুতে তাপ প্রয়োগ করলে তার পরিবহন ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ রোধ বাড়ে। এটাও ধাতব বা বিদ্যুৎ পরিবাহী বস্তুর একটি তাপমাত্রিক ধর্ম।
আবার চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে। কিন্তু একে উত্তপ্ত করলে তার চুম্বকত্ব নষ্ট হয়। তাই চৌম্বক পদার্থের এই ধর্মকেও বস্তুর তাপমাত্রিক ধর্ম বলা যায়।
নিউক্লিয়ার চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়ামের মতো ভারী মৌলগুলোকে। এসব মৌলের নিউক্লিয়াসগুলোর ভেতর নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া হয়। সেই বিক্রিয়া থেকে মুক্ত হয় তাপশক্তি। সেই তাপশক্তি বাড়িয়ে দেয় চুল্লির তাপমাত্রা।
বিদ্যুৎ পরিবাহী যেকোনো বস্তুতে তাপ প্রয়োগ করলে তার পরিবহন ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ রোধ বাড়ে। এটাও ধাতব বা বিদ্যুৎ পরিবাহী বস্তুর একটি তাপমাত্রিক ধর্ম।
তাপমাত্রিক ধর্মের ব্যবহার
তাপমাত্রিক ধর্ম কোথায় ব্যবহার হয়? সোজা কথায়, বস্তুর অবস্থা পরিবর্তনে বা কাজ আদায়ে। কী হয় তার আভাস আগেই দিয়েছি। জ্বালানি চালিত ইঞ্জিনগুলো প্রথমে জ্বালানি পুড়িয়ে তাপ উৎপন্ন করে। সেই তাপ ইঞ্জিনের পানির ট্যাংকে থাকা পানিকে উত্তপ্ত করে। পানি বাষ্পীভূত হয়। প্রবল বেগে বাষ্পগুলো বেরিয়ে আসতে চায় ইঞ্জিনের ভেতর থেকে। আসার পথে ইঞ্জিনের পিস্টনে চাপ প্রয়োগ করে।
এতে পিস্টন নির্দিষ্ট পথে নড়াচড়া করে। ফলে ইঞ্জিনের সঙ্গে থাকা চাকা বা পুলি ঘুরতে থাকে। সেগুলো আবার গাড়ি, জাহাজ, উড়োজাহাজ, শ্যালো মেশিনের পাম্প, ট্রাক্টর বা ট্রাকের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। ফলে এসব যানবাহন চলে। আগের দিনে এভাবে রাইসমিলও চালানো হতো।
এখন বিদ্যুৎ এসে অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে। বর্তমানে বৈদ্যুতিক ট্রেন, ইলেকট্রিক কার, রাইসমিল, ওয়ার্কশপগুলোতে সব বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। তাই বলে কি এসব যন্ত্রে বস্তুর তাপমাত্রিক ধর্মের কোনো অবদান নেই? আছে। তবে সেটা সরাসরি নয়, পরোক্ষভাবে।
জ্বালানি চালিত ইঞ্জিনগুলো প্রথমে জ্বালানি পুড়িয়ে তাপ উৎপন্ন করে। সেই তাপ ইঞ্জিনের পানির ট্যাংকে থাকা পানিকে উত্তপ্ত করে। পানি বাষ্পীভূত হয়।
বিদ্যুৎ ও তাপের খেলা
বিদ্যুৎ আমরা কোথা থেকে পাই? নিশ্চয়ই বলবেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। কিন্তু কেন্দ্রগুলো কতভাবেই তো বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। যেমন, পানির প্রবাহ কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় কাপ্তাই নদীতে বাঁধ দিয়ে পানির ধারার সাহায্যে। এ ছাড়া উইন্ডমিল আছে। আছে কয়লা, গ্যাস, তেল ও নিউক্লিয়ার জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। জলবিদ্যুৎ আর উইন্ডমিল ছাড়া বাকি সব ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে তাপীয় ধর্মকেই কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
কীভাবে? আচ্ছা, আগে দেখি বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেসিক প্রক্রিয়াটা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দরকার একটা জেনারেটর। জেনারেটর আসলে বৈদ্যুতিক মোটরের উল্টো রূপ। জেনারেটরে একটা চুম্বকক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে একটা রোটর থাকে। রোটর ঘুরলেই চুম্বকক্ষেত্রটা নড়াচড়া করে বা ফ্লাক্সের পরিবর্তন হয়। ফ্যারাডের সূত্র বলে, গতিশীল চুম্বকক্ষেত্র বিদ্যুতের জন্ম দেয়।
জেনারেটরের কার্যপদ্ধতি তাই খুব সরল। যেকোনোভাবে রোটরটা ঘোরান, বিদ্যুৎ তৈরি হবে। রোটর যতক্ষণ ঘুরবে, ততক্ষণ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। রোটর কী উপায়ে ঘোরাচ্ছেন, সেটা কোনো ব্যাপারই নয়।
কয়লা, তেল ও গ্যাসভিত্তিক জেনারেটরগুলোতে একটা বাষ্পীয় ইঞ্জিন থাকে। জ্বালানি পুড়িয়ে ইঞ্জিনের ভেতরের পানি গরম ও বাষ্পে পরিণত করা হয়। বাষ্প পিস্টন, পুলি, প্রপেলারকে ঘুরিয়ে দেয়। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা হয় রোটর। ফলে এগুলোর সঙ্গে রোটরও ঘোরে। চুম্বকক্ষেত্র গতিশীল হয়। উৎপন্ন হয় বিদ্যুৎ।
জেনারেটরে একটা চুম্বকক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে একটা রোটর থাকে। রোটর ঘুরলেই চুম্বকক্ষেত্রটা নড়াচড়া করে বা ফ্লাক্সের পরিবর্তন হয়। ফ্যারাডের সূত্র বলে, গতিশীল চুম্বকক্ষেত্র বিদ্যুতের জন্ম দেয়।
অন্যদিকে জলবিদ্যুতের ক্ষেত্রে অনেক উঁচু থেকে ঝরনার ধারার মতো প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত করা হয় নিচের দিকে। সেই পানি পড়ে প্রপেলারের ওপর। পানি প্রপেলার ঘুরিয়ে নিচে নেমে আসে। ঘুরন্ত প্রপেলারের সঙ্গে যুক্ত থাকে জেনারেটরের রোটর। প্রপেলারের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে রোটরও। ফলে আগের মতোই বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এখানে বস্তুর তাপমাত্রিক ধর্ম কোনো কাজে লাগে না।
একইভাবে উইন্ডমিলের পাখাগুলো সরাসরি জেনারেটরের রোটরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বাতাসের ধাক্কায় পাখা ঘোরে, জেনারেটরের রোটর ঘোরে, ফলে চুম্বকক্ষেত্র গতিশীল হয়। তৈরি হয় বিদ্যুৎ। এখানেও তাপমাত্রিক ধর্মের প্রয়োজন পড়ে না।
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে সরাসরি প্রপেলার ঘোরানোর সুযোগ নেই। এখানে নিউক্লিয়ার চুল্লি থেকে প্রচুর তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। সেই তাপ পানি গরম করে। তৈরি হয় বাষ্প। বাষ্প প্রপেলার ঘোরায়। প্রপেলারের সঙ্গে যুক্ত জেনারেটরের রোটর ঘোরে। আগের সব প্রক্রিয়ার মতোই চুম্বকক্ষেত্র গতিশীল হয়। উৎপন্ন হয় বিদ্যুৎ।
সুতরাং চারপাশে যে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ছড়াছড়ি দেখি, সেই বিদ্যুতের সিংহভাগ উৎপন্ন করা হয় বস্তুর তাপমাত্রিক ধর্ম ব্যবহার করে।