ঘূর্ণন ও কৌণিক গতির মধ্যে সম্পর্ক কোথায়

ফ্যানের গতি ঘূর্ণন গতিছবি: আমেরিকান হোম শিল্ড

মহাবিশ্ব এক দুরন্ত ঘূর্ণির ছন্দে আবদ্ধ। মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই ঘুরছে। কোনোটা নিজ অক্ষের ওপর লাটিমের মতো ঘুরছে, আবার কোনোটা ঘুরছে অন্য কোনো বস্তুকে কেন্দ্র করে। যেহেতু ঘুরছে, তাই বস্তুটা প্রতি মুহূর্তে স্থান বদল করছে। আর স্থান পরিবর্তন মানেই বস্তুটা গতিশীল। তাই যেকোনো ঘূর্ণায়মান বস্তুরই গতি আছে। যেহেতু এই বস্তুগুলো সরলরৈখিক বা সোজা পথে চলে না, তাই এর গতিকে বলা হয় ঘূর্ণন গতি।

ঘূর্ণন গতির উদাহরণ কিন্তু কম নয়। ঘরে ফ্যান ঘুরছে, লাটিম ঘুরছে, পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ঘুরছে কিংবা গাড়ির চাকা ঘুরছে। অর্থাৎ, একটা বিন্দু বা অক্ষকে কেন্দ্র করে যখন কোনো বস্তু গতিশীল হয়, সেটাকেই বলে ঘূর্ণন গতি। সাধারণ ঘূর্ণন গতির ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে বস্তুর যেকোনো একটা বিন্দুর দূরত্ব সব সময় সমান থাকে।

ঘূর্ণন গতির ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটা বৈদ্যুতিক ফ্যানের কথা ভাবা যাক। ফ্যানের যেকোনো একটা পাখার কথা কল্পনা করুন। পাখার যে অংশটা মোটরের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে মার্কার পেন দিয়ে একটা ফোঁটা বা বিন্দু দিন। ধরা যাক, এই বিন্দুর নাম A। এবার পাখাটার শেষ মাথায় আরেকটা বিন্দু ধরা যাক B। আর ফ্যানের ঠিক মাঝখানে বা কেন্দ্রে আরেকটা বিন্দু নিন C।

আরও পড়ুন
যেকোনো ঘূর্ণায়মান বস্তুরই গতি আছে। যেহেতু এই বস্তুগুলো সরলরৈখিক বা সোজা পথে চলে না, তাই এর গতিকে বলা হয় ঘূর্ণন গতি।

C থেকে A বিন্দুর দূরত্ব ধরা যাক ১০ সেন্টিমিটার। অন্যদিকে C থেকে B বিন্দুর দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার। ফ্যান ঘুরলেও এই দূরত্ব কখনো কমে বা বাড়ে না। ফ্যান যখন ঘুরবে, তখন A বিন্দুও যেমন ঘুরবে, তেমনি B বিন্দুও ঘুরবে। ফ্যান যত জোরেই ঘুরুক, কেন্দ্র C থেকে A-এর দূরত্ব (১০ সেমি) কখনো কমবেশি হবে না। তেমনি নড়চড় হবে না C থেকে B-এর দূরত্বও (৪০ সেমি)।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, A বিন্দুর রৈখিক গতি আর B বিন্দুর রৈখিক গতি কিন্তু এক নয়। B বিন্দুর গতি বেশি। কারণ, একই সময়ে A-এর তুলনায় B বিন্দু অনেক বেশি পথ পাড়ি দিচ্ছে। নিচের ছবিটা দেখলে ব্যাপারটা বুঝতে আরও সহজ হবে।

C থেকে A বিন্দুর দূরত্ব ১০ সে.মি. এবং B বিন্দুর দূরত্ব ৪০ সে.মি.

ছবির দিকে তাকালে দেখবেন, ১ সেকেন্ডে A বিন্দু হয়তো ৫ সেন্টিমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছে, কিন্তু একই সময়ে B বিন্দু ৩০ সেন্টিমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছে। অর্থাৎ, একই সময়ে B বিন্দু A বিন্দুর চেয়ে বেশি পথ অতিক্রম করছে।

সুতরাং, একটা ঘূর্ণায়মান বস্তুর বিভিন্ন বিন্দুর রৈখিক বেগ আলাদা হতে পারে। যে বিন্দু কেন্দ্র থেকে যত দূরে, তার রৈখিক বেগ তত বেশি। তবে মনে রাখতে হবে, পুরো ফ্যানটির কৌণিক বেগ কিন্তু সমান। কারণ, প্রতিটি বিন্দু একই সময়ে সমান কোণ তৈরি করছে।

আরও পড়ুন
একটা ঘূর্ণায়মান বস্তুর বিভিন্ন বিন্দুর রৈখিক বেগ আলাদা হতে পারে। যে বিন্দু কেন্দ্র থেকে যত দূরে, তার রৈখিক বেগ তত বেশি। তবে মনে রাখতে হবে, পুরো ফ্যানটির কৌণিক বেগ কিন্তু সমান।

ঘূর্ণন গতির উদাহরণ

আমাদের চারপাশে ঘূর্ণন গতির ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। লাটিম কিংবা গাড়ির চাকা নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ঘুরছে, ফলে দিন-রাত হচ্ছে। একে বলা হয় আহ্নিক গতি। এটিও ঘূর্ণন গতি।

আবার পৃথিবী সূর্যের চারপাশে একটা কক্ষপথে ঘুরছে। এটাকে ঠিক ঘূর্ণন গতি বলা যায় না, বরং এটি হলো পর্যাবৃত্ত গতি। কারণ, ঘূর্ণন গতি হতে হলে বস্তুকে নিজ অক্ষের ওপর দাঁড়িয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে হয়। কিন্তু পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার এবং পৃথিবী এখানে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাই সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর এই গতিকে ঘূর্ণন গতি না বলে বার্ষিক গতি বলাই শ্রেয়।

কৌণিক গতি

ঘূর্ণন গতি তো বোঝা গেল। কিন্তু কৌণিক গতি বা কৌণিক বেগ কী? সোজা কথায়, রৈখিক গতি মাপা হয় সোজা স্কেলে। যেমন সেন্টিমিটার, মিটার বা কিলোমিটারে। যেমন মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর আহ্নিক গতি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ৭৬০ কিলোমিটার।

সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলোর ঘোরার গতি পর্যাবৃত্ত হলেও, এই গতিকে কৌণিক গতি বিবেচনা করা হয়
ফাইল ছবি

অন্যদিকে কৌণিক গতি মাপা হয় কোণের হিসাবে, অর্থাৎ ডিগ্রিতে। প্রতি সেকেন্ড বা ঘণ্টায় একটা বস্তু কত ডিগ্রি কোণ ঘুরল বা তার কৌণিক দূরত্ব কতটুকু বাড়ল, সেটাই তার কৌণিক বেগ। পদার্থবিজ্ঞানে সাধারণত এটি মাপা হয় রেডিয়ান এককে।

অর্থাৎ, বস্তুর ঘূর্ণন এবং কৌণিক গতির মধ্যে মৌলিক কোনো সংঘাত নেই, শুধু পরিমাপের পদ্ধতিটা আলাদা। একটার মান জানা থাকলে অন্যটা সহজেই বের করা সম্ভব। আবার পর্যাবৃত্ত গতি থেকেও অনেক সময় কৌণিক গতি বের করা যায়। যেমন সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘোরাটা পর্যাবৃত্ত হলেও এর কৌণিক গতি হিসাব করা সম্ভব।

চলন-ঘূর্ণন গতি

চলন ও ঘূর্ণন গতির একটা হাইব্রিড বা মিশ্র মডেল আছে। একে বলে চলন-ঘূর্ণন গতি। ধরা যাক, আপনি সোজা পথে দৌড়াচ্ছেন, এটা বিশুদ্ধ চলন গতি। আবার ফ্যান এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘুরছে, এটা বিশুদ্ধ ঘূর্ণন গতি ।

গাড়ির চাকার গতিকে চলন-ঘূর্ণন গতি বলা হয়
ফাইল ছবি

কিন্তু কোনো বস্তু যদি একই সঙ্গে ঘোরে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তখন তাকে বলে চলন-ঘূর্ণন গতি। যেমন সাইকেল বা গাড়ির চাকা। চাকা নিজ অক্ষের ওপর ঘোরে, আবার একই সঙ্গে সামনে এগোয়। তাই এর গতিকে চলন-ঘূর্ণন গতি বলা হয়।

লেখক: সাংবাদিক

আরও পড়ুন