বস্তুর আর সব ধর্মের মতো তাপমাত্রাও মাপা যায়। এর জন্য বেশ কিছু স্কেল আছে। এক কথায় যেগুলোকে থার্মোমিটার বলে। কিন্তু স্কেল আসার আগে মানুষ তাপমাত্রা মাপত কীভাবে?
যখন স্কেল ছিল না, তখন অনুভূতিই ছিল ভরসা। তখন শুধু ঠান্ডা বা গরমের তুলনা করা হতো। এখন যেমন আমরা পরিবেশের তাপমাত্রা না মেপেও বলতে পারি, আজকের আবহাওয়া গতকালের চেয়ে কম বা বেশি। ঠিক এমন পদ্ধতি ব্যবহার হতো। সহনীয় তাপমাত্রা মাপা হতো হাত দিয়ে—এই বস্তু বেশি গরম, ওটা কম—এভাবে। এতে টুকটাক কাজ চালিয়ে নেওয়া যায় বটে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক কাজ চলে না।
ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি হলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের জন। তিনি যেমন প্রকৃতির সূত্রগুলো বোঝার চেষ্টা করেছেন, তেমনি পরীক্ষা নীরিক্ষা করে সেগুলোর বাস্তবতা প্রমাণ করেছেন। তেমনি তাপমাত্রা নিয়েও তার চিন্তাভাবনা ছিল, সেই ভাবনারই ফসল হলো তাঁর বিখ্যাত থার্মোস্কোপ যন্ত্র। ১৫৯২ সালে গ্যালিলিও যন্ত্রটি তৈরি করেন। কিন্তু সেটা দিয়েও তাপমাত্রার পরিবর্তটাই শুধু বোঝা যেত। তাপমাত্রার কোনো স্কেল গ্যালিলিওর থার্মোস্কোপে ছিল না। তবে সেটাও যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ ছিল। মানব অনুভূতি ছাড়াই শুধু যন্ত্রের সাহায্যে তাপমাত্রার পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে, এটাই বা কম কী!
১৫৯২ সালে গ্যালিলিও যন্ত্রটি তৈরি করেন। কিন্তু সেটা দিয়েও তাপমাত্রার পরিবর্তটাই শুধু বোঝা যেত। তাপমাত্রার কোনো স্কেল গ্যালিলিওর থার্মোস্কোপে ছিল না।
তাপমাত্রা বাড়লে যে বস্তুর আয়তন বাড়ে এই ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের জানা ছিল, তাই মধ্যযুগের বিজ্ঞানীরা বস্তুর এই তাপমাত্রিক ধর্মকে ব্যবহার করে তাপমাত্রা পরিমাপের একটা একটা যন্ত্র তৈরির চেষ্টা করেন। কিন্তু যে কোনো বস্তু দিয়ে তো আর বানানো চলে না। লোহা বা পাথরের প্রসারণ অত সহজে বোঝা যায় না। তাই এমন কিছু চাই যা দ্রুত প্রসারিত হয়।
পানিও দ্রুত প্রসারিত হয়। কিন্তু পানি খুব সহজেই বাষ্পে পরিণত হয়। তাই অ্যালকোহল ও পারদ ব্যবহারের কথা ভাবলেন বিজ্ঞানীরা। এই পদার্থ দুটি তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত প্রসারিত হয়। আবার দ্রুত সংকুচিতও হয়। এগুলোতে অনেক বেশি তাপ দিলেও এগুলো বাষ্পীভূত হয় না। তাই উচ্চ তাপমাত্রাও মাপা সম্ভব।
কিন্তু যদি স্কেলের মাপ নিতে হয় তাহলে খোলা জায়গায় পারদ বা অ্যালকোহল রাখলে চলে না। এজন্য তাঁরা একটা কাঁচের সরু নলের ভেতর অ্যালকোহল বা পারদ ঢেলে তার মুখ বন্ধ করে দিলেন। তৈরি হলো।
১৬৫৪ সালে সত্যিকারের একটা অগ্রগতি হলো। ইতালির গ্র্যান্ড ডিউক দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ একটা থার্মোমিটার তৈরি করেন। তিনি একটা কাঁচের নলে রঙিন অ্যালকোহল ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দেন। কাচনলের গায়ে তিনি ৫০টা দাগ কাটেন। তাপমাত্রা বাড়লে অ্যালকোহল ওঠানামা করে এবং অ্যালকোহলের ওপরের প্রান্ত কোথায় অবস্থান করছে, সেটা দেখে মোটামুটি তামাত্রার বাড়া-কমার ব্যাপরটা বোঝা যায়।
কিন্তু এই থার্মোমিটারেও সমস্যা ছিল। ঠিক কোন পদার্থের তাপমাত্রার সাপেক্ষে এটা তৈরি করা হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করা ছিল না। অর্থাৎ এর স্কেলের ৫০টা দাগ সমান দূরত্বে কাটা হয়েছিল বটে, কিন্তু সেগুলো ঠিক কীসের ভিত্তি তৈরি করা হলো, সে বিষয়টা নিশ্চিত ছিল না।
১৬৫৪ সালে সত্যিকারের একটা অগ্রগতি হলো। ইতালির গ্র্যান্ড ডিউক দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ একটা থার্মোমিটার তৈরি করেন। তিনি একটা কাঁচের নলে রঙিন অ্যালকোহল ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দেন।
শূন্য ডিগ্রির আবির্ভাব
১৬৬৪ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট হুক একটা থার্মোমিটার তৈরি করেন। তিনি আর ফার্দিনান্দের মতো ভুল করলেন না। এ থার্মোমিটারে তিনি শূন্য ডিগ্রির প্রচলন শুরু করেন। যে তাপমাত্রায় বরফ গলে পানিতে পরিণত হয় অথবা যে তাপমাত্রায় পানি জমে বরফে পরিণত হয়, সেই তাপমাত্রাকে তিনি শূন্য ডিগ্রি ধরলেন। আজ পর্যন্ত শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রার সবচেয়ে প্রচলিত স্কেল এটাই। হুক কাঁচ নলের ভেতর অ্যালকোহল ঢুকিয়ে তার মুখ বন্ধ করে দেন। তারপর পুরো নলটাকে সমান দূরত্বে পাঁচ শটা দাগ কাটেন। কিন্তু সেই মাপও অতটা ফলপ্রসু হয়নি।
১৭০১ সালে গুরু গ্যালিলিওর পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্যার আইজ্যাক নিউটনও একটা থার্মোমিটার তৈরি করেন। তিনিই একটা কাঠামোতে নিয়ে আসেন থার্মোমিটারকে। বরফের গলনাংককে শূন্য এবং মানুষের শরীরের তাপমাত্রাকে সর্বোচ্চ ধরে স্কেল তৈরি করেন। এর সমস্যা হলো মানুষের শরীরে চেয়ে বেশি তাপমাত্রার মাপতে গেলে ঝামেলা তৈরি বাঁধে।
এরপর ১৭০২ সালে ডেনিস বিজ্ঞানী ওলে ক্রিস্টেনসন রোমার একটা থার্মোমিটার তৈরি করেন। তাপমাত্রার স্কেল হিসেবে ডিগ্রির প্রচলন করেন তিনিই প্রথম। রোমার বরফ গলনের তাপমাত্রাকে সাড়ে সাত ডিগ্রি ধরে হিসাব করেন। আর যে তাপমাত্রায় পানি ফোটে সেটাকে ৬০ ডিগ্রি ধরে কাচনলে দাগ কাটেন। রোমারের থার্মোমিটারই আধুনিক থার্মোমিটার তৈরির পথ খুলে দেয়।
১৭০১ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন একটা কাঠামোতে নিয়ে আসেন থার্মোমিটারকে। বরফের গলনাংককে শূন্য এবং মানুষের শরীরের তাপমাত্রাকে সর্বোচ্চ ধরে স্কেল তৈরি করেন।
ফারেনহাইট স্কেলের যাত্রা শুরু
১৭৪১ সালে আসে সালে সাফল্য। জার্মান বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট সে বছর একটা থার্মমিটার তৈরি করেন। এটাই পৃথিবীর প্রথম সফল থার্মোমিটার। যেকোনো স্কেল তৈরি করতে হলে একটা তূল্য বস্তু লাগে।
ফারেনহাইট থার্মোমিটারের প্রথম লক্ষ্যই ছিল শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট নির্ণয় করা। এর জন্য তিনি সমান পরিমাণ বরফ, পানি ও লবণের একটা মিশ্রণ তৈরি করেন। সেই মিশ্রণের যে তাপমাত্রা, সেটাকে স্কেলের শুরুর বিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেন। শুরুর সেই বিন্দুটা হলো শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট। এরপর তিনি মানব শরীরের গড় তাপমাত্রাকে ৯৬ ডিগ্রি হিসেবে ধরেন। যে তাপমাত্রায় পানি ফোটে, সেটাকে ২১২ ডিগ্রি ধরে স্কেলে দাগ কাটেন। অন্য দিকে বরফ গলনের তাপমাত্রা দাঁড়া ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। রোমারের প্রতি ডিগ্রিকে চারভাগ করে সেটাকে ১ ডিগ্রি ধরেন ফারেনহাইট। এতে তুলনামূলক অনেক সূক্ষ্ম তাপমাত্রা মাপা সম্ভব হয়। আর এজন্য তিনি অ্যালকোহলের বদলে পারদের ব্যবহার শুরু করেন।
অনেক পুরোনো হলেও ফারেনহাইট স্কেল এখনো ব্যবহৃত হয়। শরীরের তাপমাত্রা কিংবা জ্বর মাপতে সারা পৃথিবীতেই ফারেনহাইট স্কেল চালু রয়েছে আজ। অন্যদিকে অ্যালকোহলের চেয়ে পারদের সুবিধা হলো, স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এটা তরল। অনেক বেশি তাপমাত্রাতেও তরল থাকে। এর নিজস্ব উজ্জ্বলতা আছে। অ্যালকোহল থার্মোমিটারে অ্যালকোহলের সঙ্গে রঙ মেশাতে হয়। ফলে অ্যালকোহলের নিজস্ব তাপমাত্রিক ধর্মও পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবার রঙের মিশ্রণের অনুপাতও কমবেশি হলে দেখা দেয় ঝামেলা । তখন একেক থার্মোমিটার একেক পাঠ দিতে শুরু করে। কিন্তু পারদে এই সমস্যা নেই।
ফারেনহাইট স্কেলের কিছু দুর্বলতা আছে। কেন বরফ গলনের তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি, কেন পানি ২১২ ডিগ্রিতে ফোটে, এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তাছাড়া ফারেনইহট স্কেল বেশ জটিল। সাধারণ ল্যাবেরটিরর কাজ করতে গেলে অনেক হিসাব করতে হয়। সেসব কাজে ফারেনহাইট স্কেল ব্যবহার অতটা সুবিধাজনক নয়।
ফারেনহাইট থার্মোমিটারের প্রথম লক্ষ্যই ছিল শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট নির্ণয় করা। এর জন্য বিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গ্যাব্রিয়েল ফারেনহাইট সমান পরিমাণ বরফ, পানি ও লবণের একটা মিশ্রণ তৈরি করেন।
সেলসিয়াসে স্বস্তি
ফারেনহাইট স্কেলের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে এবং আরও সহজে হিসাব কষার জন্য নতুন একটা থার্মোমিটারের প্রয়োজন পড়ে। সেই কাজটি করেন বিখ্যাত সুইডিস বিজ্ঞানী অ্যান্ডের্স সেলসিয়াস। তিনি বরফের গলনের তাপমাত্রাকে ধরেন ১০০ ডিগ্রি এবং যে তাপমাত্রায় পানি ফুটতে শুরু করে, তার তাপমাত্রা ধরেন শূন্য ডিগ্রি। ব্যাপারটা বেশ মজার। সমস্যাটাও প্রকট। কারণ যে তাপমাত্রায় পানি ফোটে, কোথাও যদি তারচেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকে তাহলে সেখানে কীভাবে কাজ করবে এই থার্মোমিটার? তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তো ডিগ্রির মানও বাড়া উচিত!
এই সমস্যার সমাধান সেলসিয়াস করতে পারেননি। কারণ, ১৭৪৪ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সেই তিনি মারা যান। এরপর আরেক সুইডিশ বিজ্ঞানী জীববিজ্ঞানে শ্রেণিবিন্যাস তত্ত্বের জনক ক্যারোলাস লিনিয়াস সেলসিয়াসের স্কেলটাকে উল্টে দেন। তিনি বরফের গলনের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি এবং যে পানির স্ফুটনাংককে ১০০ ডিগ্রি ধরে থার্মোমিটাটিকে পুনর্বিন্যাস করেন। সেটাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় থার্মোমিটার।
এই থার্মোমিটার তিনি তৈরি করেন ১৭৪২ সালে। পৌনে তিন শ বছর পেরিয়ে এসেও সেলসিয়াসের এই থার্মোমিটার এখনো সমান জনপ্রিয়। ল্যাবরেটরিতে, সাধারণ কাজে, আবহাওয়া সংক্রান্ত হিসাব-নিকাষে এই থার্মোমিটারই ব্যবহৃত হয়। এর ডিজিটাল রূপও প্রচলিত। ইলেকট্রনিক ডিভাইস মোবাইল ফোন, কম্পিউটারসহ অন্যন্য ডিভাইসেও এই থার্মোমিটারের পাঠ দেখায়। এককের যে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি সেখানেও তাপমাত্রার স্কেল হিসেবে সেলসিয়াস স্কেল ব্যবহার করা হয়।
বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস বরফের গলনের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি এবং যে পানির স্ফুটনাংককে ১০০ ডিগ্রি ধরে থার্মোমিটাটিকে পুনর্বিন্যাস করেন। সেটাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় থার্মোমিটার।
কেলভিনের পরমশূন্য তাপমাত্রা
সেলসিয়াস স্কেলে শূন্য ডিগ্রি থেকে অতি উচ্চ তাপমাত্রা বেশ সহজেই মাপা যায়। কিন্তু শুধু উচ্চতামাত্রা দিয়েও তো মহাবিশ্ব, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো চলে না। শূন্য ডিগ্রির চেয়েও কম তাপমাত্রার দরকার হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাপগতিবিদ্যার স্বর্ণযুগ। গ্যাসে আয়তনের ওপর তাপমাত্রা চাপের প্রভাব নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। সেখানে যেমন উচ্চতামাত্রার হিসাব-নিকাষ আসে, তেমনি অনেক নিম্ন তাপমাত্রারও হিসাব চলে আসে। সেই তাপমাত্রা কীভাবে মাপা হবে?
তখনকার বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, সেলসিয়াস স্কেলে এসব কাজ চলবে না। এর জন্য চাই আরও সূক্ষ্ম থার্মোমিটার। ১৮৬২ সালে স্কটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম টমসন, যাকে সবাই লর্ড কেলভিন নামে চেনে, তিনি একটা সমাধান বের করেন। তিনি হিসাব কষে দেখান, মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সকল পদর্থের সব অণু (এবং পরমাণু) গতিশূন্য হয়ে যায়। এমন এই তাপমাত্রায় বায়ুচাপ থেকে শুরু করে, সকল প্রকার চাপ শূন্য হয়ে যায়। কারণ অণু-পরমাণুগুলো যদি ছোটাছুটি নাই করতে পারে, চাপ তৈরি হবে কী করে?
শুধু তাই নয়, হিসাব কষে আরও দেখা গেল, এই তাপমাত্রায় আসলে মহাবিশ্বে কোনো ঘটনাই ঘটা সম্ভব নয়। যেহেতু মহাবিশ্ব মৃত নয়, তাই মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কোনোভাবেই পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই এই তাপমাত্রার নাম দেওয়া হলো পরমশূন্য তাপমাত্রা।
লর্ড কেলভিন মাইনাস ২৭৩.১৫ সেলসিয়াসকে শূন্য ধরে তাপমাত্রা পরিমাপের একটা স্কেল বা থার্মোমিটারের প্রস্তাব করেন। সেই স্কেলই হলো কেলভিন স্কেল। তাপগতিবিদ্যায়, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, অ্যাস্ট্রোফিজিকস কিংবা কসমোলজিতে এই স্কেলই সবচেয়ে জনপ্রিয়।