সহজপাঠ
পর্যাবৃত্ত গতি ও তরঙ্গগতির পার্থক্য
ঘড়ির কাঁটা কেন বারবার ফিরে আসে একই ছন্দে? গির্জার ঝাড়বাতির দুলুনি দেখেই কি গ্যালিলিও পেয়েছিলেন গতির গোপন সূত্র? নিউটনের গণিত আর গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণে কীভাবে বদলে গেল মহাবিশ্বের গতির ধারণা? তরঙ্গগতির সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়?
পদার্থবিজ্ঞানের সহজপাঠ ১৪
প্রাচীনকালে মানুষ যখন গতির ব্যাখ্যা করতে শেখেনি, তখনই মানুষ জেনে গিয়েছিল; একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর চাঁদ ও সূর্য আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আকাশের তারাগুলোর অবস্থানও একইভাবে ফিরে ফিরে আসে। পৃথিবীর ঋতুচক্রের বদল হয়, বছর শেষে আবার পুরোনো ঋতু ফিরে আসে। আর এসবের সূত্র ধরেই তৈরি হয় প্রাচীন বাৎসরিক ক্যালেন্ডার।
এই যে বারবার একইভাবে গ্রহ-নক্ষত্রের ফিরে আসা, এটা কেন হয়? সেকালের পর্যবেক্ষকেরা গতিবিদ্যার খুঁটিনাটি জানতেন না। তাই তাঁরা বুঝতে পারেননি, এগুলো পর্যাবৃত্ত গতির উদাহরণ। তবে মধ্যযুগে এসে পোলিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস ও জার্মান বিজ্ঞানী জোহান কেপলার বুঝতে পারেন, সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। তাই বছরের একটা নির্দিষ্ট দিনে এসে পৃথিবী আর সূর্যের দূরত্ব সবচেয়ে কম হচ্ছে। তেমনি একটা নির্দিষ্ট দিনে দূরত্ব হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
অর্থাৎ, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, ঠিক এক বছর পর যেন আবার আগের রূপ ফিরে পাচ্ছে। তেমনি চাঁদও প্রতি ২৮ দিনে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আগের অবস্থানে ফিরে আসছে। এর সঙ্গে পৃথিবীর বার্ষিক গতি ও চাঁদের মাসিক গতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গতির কারণে কোনো বস্তুর বারবার একই দশায় ফিরে আসার ব্যাপারটাকে বলে পর্যাবৃত্ত গতি।
১২তম পর্বে আমরা কৌণিক গতির কথা বলেছি। কৌণিক গতিও আসলে পর্যাবৃত্ত গতির উদাহরণ। যেমন গাড়ির চাকা বৃত্তাকারে ঘোরে, কিন্তু চাকার কোনো একটা বিন্দু প্রতি ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরার পর আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তাই গাড়ির যেকোনো বিন্দু বা অংশের জন্য ঘূর্ণন গতি আসলে একধরনের পর্যাবৃত্ত গতি।
মধ্যযুগে এসে পোলিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস ও জার্মান বিজ্ঞানী জোহান কেপলার বুঝতে পারেন, সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে।
প্রাচীনকালের বিজ্ঞানীরা গ্রহ-উপগ্রহের গতি সম্পর্কে জানলেও পর্যাবৃত্ত গতির স্বরূপটা বুঝতে সক্ষম হননি। মধ্যযুগে এসে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি এটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তিনি যেমন গ্রহ-উপগ্রহদের গতি পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনি বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার গতির বাইরেও যে পর্যাবৃত্ত গতি থাকতে পারে, তাও তিনিই প্রথম পরীক্ষা করেন। এই বিষয়টা নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটা এমন:
একদিন গ্যালিলিও গিয়েছিলেন চার্চে। সেখানে একটা ঝুলন্ত ঝাড়বাতি ছিল। সেই ঝাড়বাতিদানে থাকত অনেকগুলো মোমবাতি। গ্যালিলিও সেদিন খেয়াল করেন, একজন লোক বাতিদানে মোমবাতি বদলে দিচ্ছে। তার কাজ শেষ হলে ঝাড়বাতিটা দুলতে শুরু করে। দোলনটা তিনি খুব ভালো করে খেয়াল করেন। তিনি বাড়ি ফিরে এ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেন। তারপর একটা সুতায় লোহার গোলক লাগিয়ে তৈরি করে ফেলেন সরল দোলক। এ নিয়ে আমরা সরল দোলকের অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আবিষ্কার করে ফেলেন সরল দোলকের ধর্ম।
ব্যাপারটা ছিল, কোনো একটা বস্তুকে দড়ি বা সুতার সাহায্যে ঝুলিয়ে দিলে বস্তুটা এপাশ থেকে ওপাশে দুলতে থাকবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর বস্তুটা আগের অবস্থানে ফিরে আসবে। বৃত্তীয় বা কৌণিক গতি না হলেও সরল দোলক আসলে পর্যাবৃত্ত গতির উদাহরণ।
গ্যালিলিও আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু গ্যালিলিওর কাজগুলোকে সত্যিকারের ভাষা দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন। তিনি গতিসূত্র প্রণয়ন করেছিলেন গণিতের ভাষায়। সরল দোলকের গতি, ব্যাখ্যা আর গাণিতিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন নিউটন। আর পর্যাবৃত্ত গতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাঁর মাধ্যমেই।
কোনো একটা বস্তুকে দড়ি বা সুতার সাহায্যে ঝুলিয়ে দিলে বস্তুটা এপাশ থেকে ওপাশে দুলতে থাকবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর বস্তুটা আগের অবস্থানে ফিরে আসবে।
নিউটনের ব্যাখ্যাটা ছিল এমন: ধরা যাক, কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করা হলো। ফলে বস্তুটা একদিকে সরে গেল। তারপর বস্তুটার ওপর থেকে প্রযুক্ত বল তুলে নিলে বস্তুটা দুলতে শুরু করবে। বারবার টেনে আনার জায়গায় ফিরে আসবে। আবার যেখান থেকে টেনে আনা হয়েছিল, সেখানে ফিরে যাবে। পর্যায়ক্রমে উল্টো দিকে যাওয়া আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসার এই ব্যাপারটাই হলো পর্যাবৃত্ত গতি।
এটা যেমন সরল দোলকের ক্ষেত্রে খাটে, নিউটনের এই ব্যাখ্যা ধরে হিসাব করলে আরও অনেক রকম পর্যাবৃত্ত গতি পাওয়া যাবে। যেমন একটা স্প্রিংকে টেনে ধরে ছেড়ে দিলে স্প্রিংটা অনেকক্ষণ ধরে সংকুচিত ও প্রসারিত হবে। তাই স্প্রিংয়ের এ ধরনের গতিকে পর্যাবৃত্ত গতি বলা যায় নিঃসঙ্কোচে।
এবার নিজে মাথা খাটিয়ে আপনার চারপাশে এমন পর্যাবৃত্ত গতির খুঁজে দেখুন তো? ঘড়ির কাঁটার গতি পর্যাবৃত্ত গতি। এখানে অবশ্য একবার বল প্রয়োগ করে ছেড়ে দিলেই চলে না। বৈদ্যুতিক ব্যাটারির সাহায্যে বল প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে ঘড়ির কাঁটাও বারবার ঘুরে একই স্থানে ফিরে আসে।
সরল দোলকের মতো না হলেও এটাও পর্যাবৃত্ত গতি। আগে যে গ্র্যান্ডফাদার ক্লক বা দোলক ঘড়ি ছিল, সেগুলোও পর্যাবৃত্ত গতির ধর্ম মেনে চলত। দোলনায় শিশুকে বসিয়ে দোল দেওয়া হয়, এটাও আসলে পর্যাবৃত্ত গতি। আমাদের যে হৃৎস্পন্দন, যার ফলে হৃৎযন্ত্র বারবার সংকুচিত ও প্রসারিত হয়ে রক্ত পাম্প করে, এটাও আসলে পর্যাবৃত্ত গতির উদাহরণ।
একটা স্প্রিংকে টেনে ধরে ছেড়ে দিলে স্প্রিংটা অনেকক্ষণ ধরে সংকুচিত ও প্রসারিত হবে। তাই স্প্রিংয়ের এ ধরনের গতিকে পর্যাবৃত্ত গতি বলা যায় নিঃসঙ্কোচে।
তরঙ্গ কী, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই জানেন? প্রতিটি তরঙ্গের ক্ষেত্রেও পর্যাবৃত্ত গতির ঘটনা ঘটে। তরঙ্গের কথা যখন এল, শব্দতরঙ্গের কথাই আগে বলি। শব্দতরঙ্গ বায়ুমণ্ডলের অণুগুলোকে ধাক্কা দেয়। এই ধাক্কায় অণুগুলো সামনে-পেছনে দুলতে থাকে। তৈরি হয় পর্যাবৃত্ত গতি।
বৈদ্যুতিক তরঙ্গ, পানির তরঙ্গ, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কিংবা আলো বা বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ পর্যাবৃত্ত গতি মেনে চলে। তবু আলাদা করে তরঙ্গগতি নামে একধরনের গতির সন্ধান পাওয়া যায় পদার্থবিজ্ঞানে। যেমন সরল ছন্দিত গতি। এটা আলাদা কেন করা হলো?
আসলে সব ধরনের তরঙ্গই পর্যাবৃত্ত গতি হলেও সব পর্যাবৃত্ত গতি তরঙ্গগতি নয়। তাই আলাদা করে তরঙ্গগতির ধর্ম ব্যাখ্যার জন্য সংজ্ঞা ও তত্ত্বের দরকার পড়ে। পরের পর্বে আমরা সেসব ব্যাখ্যা জানব। এখন আমরা একটা উপসংহারে পৌঁছাতে পারি। পর্যাবৃত্ত গতির সংজ্ঞাটা আসলে কী? কোনো গতিশীল বস্তু যদি একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর একই অবস্থানে বা একই দশায় ফিরে ফিরে আসে, তাহলে সেই বস্তুর গতিকে পর্যাবৃত্ত গতি বলে।